ইরানে চলমান অস্থিরতা ও ইসরায়েলের সামরিক হামলার প্রেক্ষাপটে আবারও সামনে এসেছে দেশটির সাবেক শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির পুত্র প্রিন্স রেজা পাহলভির নাম। সম্প্রতি তিনি সরাসরি আহ্বান জানিয়েছেন, ইরানের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে সমর্থন না করে সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়াতে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই বক্তব্য তার দীর্ঘদিনের উদ্দেশ্য— ক্ষমতায় ফেরার প্রচেষ্টারই অংশ।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে যাওয়া রেজা পাহলভি শুরু থেকেই ইসলামী প্রজাতন্ত্রের কট্টর সমালোচক এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত। তবে সম্প্রতি তার অবস্থান আরও বেশি পশ্চিমাপন্থী ও ইসরায়েলঘেঁষা হয়ে উঠেছে, যা ইরানের অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
রেজা পাহলভি প্রকাশ্যে বলেছেন, তিনি চান ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হোক— যেমনটি ছিল তার পিতার শাসনামলে। তার দাবি, ইসলামিক রিপাবলিক শাসনব্যবস্থাই মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার মূল উৎস। সমালোচকরা বলছেন, তিনি এখন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের কণ্ঠে কথা বলছেন এবং এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করছেন।
বিদেশি সমর্থন এবং সন্দেহ
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রেজা পাহলভির এ উদ্যোগে তাকে সরাসরি সমর্থন দিচ্ছে ইসরায়েল ও কিছু পশ্চিমা শক্তি। কারণ তার দর্শন— ইসলামিক রিপাবলিকের পতন— পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকেও উপকারী বলে বিবেচিত। তিনি ধর্মঘট, রাজপথে বিক্ষোভ এবং অভ্যন্তরীণ চাপকে সরকার পতনের পথ হিসেবে দেখছেন, যদিও প্রকাশ্যে অভ্যুত্থান বা বিদেশি হস্তক্ষেপের কথা অস্বীকার করেন।
তবে সমালোচকদের দাবি, তার বক্তব্য ও কৌশল আসলে একধরনের ‘বাইরের মাধ্যমে ভেতরের পরিবর্তন’— যা অনেক ইরানির কাছে বিদেশি হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি।
ইসরায়েলি হামলার রাজনৈতিক পটভূমি
সম্প্রতি ইসরায়েল যে হামলা চালিয়েছে, তা শুধু ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হানার উদ্দেশ্যেই নয়, বরং রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়ে সরকারকে দুর্বল করার কৌশলও এর অন্তর্ভুক্ত। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মতে, যদি ইরানিরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করে, তাহলে ইসলামিক সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব হতে পারে।
অর্থনৈতিক সংকট, দমনমূলক শাসন ও মতপ্রকাশের অভাবে অনেক ইরানি জনগণ অসন্তুষ্ট। বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল ও তার মিত্ররা এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চাইছে।
ইরান-ইসরায়েল: এক জটিল ইতিহাস
ইরান ও ইসরায়েলের বর্তমান বৈরী সম্পর্ক অতীতে এমন ছিল না। শাহর আমলে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল, ইরান ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, এমনকি তেল সরবরাহও করত। তবে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর খামেনির নেতৃত্বাধীন ইসলামিক রিপাবলিক ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং একে অবৈধ রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয়।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামিক সরকারের পতনের পর কে ক্ষমতায় আসবে— তা এখনও স্পষ্ট নয়। রেজা পাহলভি নেতৃত্ব দিতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। কারণ একদিকে তার পশ্চিমাপন্থী অবস্থান, অন্যদিকে শাহ শাসনের অতীত স্মৃতি এখনও অনেক ইরানির মনে রয়ে গেছে। কেউ কেউ মনে করেন, তার ফিরে আসা মানে আবারও স্বৈরতন্ত্রের সম্ভাবনা।
ইরান সরকার চাইছে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং বড় পরিসরের যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে। তবে চলমান অস্থিরতা ও বাহ্যিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কা মধ্যপ্রাচ্যকে আরও একটি বিপজ্জনক মোড়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে।