২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট—গণ আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পলায়ন। এক নতুন বাংলাদেশে ৫ আগস্টের নাম হলো ‘৩৬ জুলাই’। এই একুশ দিনের ঘটনাবলী যেন পুরো বাংলাদেশ ও বিশ্বের কাছে ভীতিকর এক ইতিহাস।
জুলাই ৩৬ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় দিন হিসেবে চিহ্নিত। ২০২৪ সালের জুলাই মাসজুড়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। শুরুতে ১ জুলাই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সংগঠনটি এই আন্দোলনের সূচনা করে। শিক্ষার্থীরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য লাগাতার কর্মসূচি পালন করতে থাকে।
কিন্তু ঘটনায় মোড় নেয় ১৪ জুলাই থেকে। এদিন শেখ হাসিনার ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ মন্তব্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এরপর সরকারের নির্দেশে আন্দোলনকারীদের ওপর চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা, গুম এবং নির্বিচারে হত্যা। এই ঘটনাগুলো ‘জুলাই গণহত্যা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। শিক্ষার্থীরা নয় দফা দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
জুলাই মাসজুড়ে এই আন্দোলন চলতে থাকে। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে বহু শিক্ষার্থীর প্রাণহানি ঘটে। আগস্ট শুরু হলেও, আন্দোলনকারীরা নিজেদের দাবি পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আগস্ট মাসের দিনগুলোকেও জুলাই হিসেবে গণনা করতে থাকে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে এবং বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এই দিনটিকে আন্দোলনকারীরা ‘৩৬ জুলাই’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় এবং এই দিনটিকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ হিসেবে অভিহিত করে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার (ইউএনসিএইচআর) প্রতিবেদনে উঠে এসেছে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের সেই নৃশংস চিত্র। গণহত্যা অভিযান পরিচালনার সরাসরি অভিযোগ ওঠে আওয়ামী লীগ, এর অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতিবেদনগুলোতেও উঠে এসেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সেসময়ের নৃশংস কর্মকাণ্ড। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্টেও সারা দেশে আন্দোলনকারীদের কঠোরভাবে দমনের চেষ্টা করা হয়েছে। সেদিন ঢাকার আশুলিয়ায় ঘটে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড। ছয়জনের নিথর দেহ গাড়িতে উঠিয়ে পুড়িয়ে ফেলে পুলিশ। এদের মধ্যে একজনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। লাশ পোড়ানোর সেই ভিডিও দেখে আঁতকে উঠেছিল গোটা দেশ।
২০২৪ সালের ১৭ জুলাই বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে শিরোনাম ছিলো, ‘রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে লক্ষ্য করে পুলিশের গুলি, ঠিক কী ঘটেছিল?’ প্রতিবেদনে উঠে আসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ছবি ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বক্তব্য। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খুব কাছ থেকেই গুলি করা হয় আবু সাঈদকে। তার বুক পুলিশের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল। তার গলা থেকে ঊরু পর্যন্ত ছিল ছররা গুলির আঘাত।
উল্লেখযোগ্য আরেক ঘটনা ছিলো রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে গুলি। সম্প্রতি ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা গণ–অভ্যুত্থানের সময় র্যাবের হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণের প্রমাণ পেয়েছে। এই মূল কাজটা করেছেন র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ। তার অধীন কর্মকর্তারাও এতে জড়িত ছিলেন।
১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট ও ১৮ জুলাই রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। পাঁচ দিন পর গত ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত পরিসরে ফেরে। তবে ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করে আওয়ামী লীগ সরকার। কারণ হিসেবে বলা হয় ডেটা সেন্টারে অগ্নিসংযোগ। ক্ষমতাচ্যুতির একদিন আগেও- অর্থাৎ ৪ আগস্ট গণমাধ্যমের সামনে সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেছিলেন, ‘আমরা কোথাও ইন্টারনেট বন্ধ করিনি। বন্ধের কোনো নির্দেশও দেইনি। কোথাও কোথাও ইন্টারনেটের সমস্যা হচ্ছে। এটা আমাদের নির্দেশনার কারণে নয়।’