একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। মঙ্গলবার (২৭ মে) প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে ৭ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন। বুধবার (২৮ মে) সকাল সাড়ে ৯টায় মুক্তি পেয়ে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বের হন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আজহারুল ইসলামকে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছিল। তার খালাসের রায়ের মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়ার অবসান ঘটলো।
কে এই এটিএম আজহারুল ইসলাম?
আবু তোরাব মোহাম্মদ আজহারুল ইসলাম যিনি এটিএম আজহারুল ইসলাম নামেই পরিচিত, তিনি ১৯৫২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার বাতাসিওন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম ডাঃ নাজির হোসেন আহমেদ। পেশায় একজন ব্যবসায়ী হলেও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ. পাশ করেন। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা, ইংরেজি এবং উর্দু ভাষায় তার দক্ষতা রয়েছে।
এটিএম আজহার বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি দৈনিক সংগ্রামের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও, তিনি মারুফ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, রংপুরের আল-আমিন ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান, তামিরুল মিল্লাত ট্রাস্টের সদস্য, বদরগঞ্জ উন্নয়ন সমিতির চেয়ারম্যান, এবং বদরগঞ্জ ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন।
উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, এটিএম আজহার ১৯৯৬ সালের জুন মাসে রংপুর-২ আসন থেকে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৮ হাজার ২৭৩ ভোট পেয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পান। এরপর ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি রংপুর-২ আসনের জন্য জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ছিলেন এবং ১৭ হাজার ৭৮৮ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি রংপুর-২ আসন (বদরগঞ্জ এবং তারাগঞ্জ) থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৩৬ হাজার ৫৮৬ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার পর আজহার দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে তিনি ঢাকা মহানগর জামায়াতের আমিরের দায়িত্ব পান এবং ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হন। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ যুদ্ধাপরাধ মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর কিছুদিনের জন্য ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন আজহার। ২০১২ সালের ২২ আগস্ট তিনিও একই অভিযোগের মামলায় মগবাজারের বাসা থেকে গ্রেপ্তার হন। তখন থেকেই তিনি কারাগারে ছিলেন।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে রংপুরে সংঘটিত গণহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ মোট ছয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড ও বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করে। সে রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করলে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ তাঁর মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই তিনি রিভিউ আবেদন করেন, যেখানে ১৪টি যুক্তি তুলে ধরা হয়।
চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ তার আপিল শুনানির অনুমতি দেন। এরপর নিয়মিত আপিলের শুনানি শেষে ২৭ মে আদালত রায় ঘোষণা করেন, যেখানে তাকে সকল অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়। ২৮ মে মুক্তি পেয়ে তিনি বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বের হন। এই রায়ের মধ্য দিয়ে একটি দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের অবসান ঘটলো।