ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ি প্রায় চার দশক ধরে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরানকে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে সুন্নি শাসিত দেশগুলোর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ও আঞ্চলিক শক্তিতে রূপান্তর করেছেন। একইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতি তার আপসহীন বিরোধিতা এখনও অটল। এ সময়ে দেশে একের পর এক গণবিক্ষোভ হলেও তিনি সেগুলো কঠোর হাতে দমন করেছেন।
ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ও অদ্বিতীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির উত্তরসূরি হিসেবে শুরুর দিকে অনেকে খামেনেয়িকে দুর্বল ও অনুপযুক্ত বলে মনে করতেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ক্ষমতার সব খুঁটিনাটি নিজের হাতে তুলে নেন এবং এখন ইরানের একমাত্র চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগ্রহণকারী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।
যখন তিনি শীর্ষ নেতার দায়িত্ব নেন, তখন তার ‘আয়াতুল্লাহ’ উপাধিটুকুও ছিল না। খোমেনির ছায়াতেই তিনি এগিয়েছিলেন। যদিও তিনি নিজে খোমেনির মতো উচ্চ ধর্মীয় মর্যাদা গড়তে পারেননি, তবু দেশের নিরাপত্তা কাঠামো শক্তিশালী করে এবং প্রভাবশালী গোষ্ঠীকে পাশে রেখে তিনি নিজের ক্ষমতা অটুট রেখেছেন। খবর রয়টার্সের।
ইরানের শাসন কাঠামোতে সর্বোচ্চ নেতাকে চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ নেই। একের পর এক প্রেসিডেন্ট এসেছেন, গেছেন—তাদের নীতি-আদর্শের ওপরও ছায়ার মতো প্রভাব বিস্তার করেছেন খামেনেয়ি।
পারমাণবিক কর্মসূচির পক্ষে তিনি সবসময় অনড় থেকেছেন, যা ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্বকে শঙ্কিত করেছে। তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ইসরায়েল গাজায় হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনে হুতি এবং ইরাকের ইরানপন্থী গোষ্ঠীর ওপর হামলা চালায়। সিরিয়ায় খামেনেয়ির ঘনিষ্ঠ মিত্র বাশার আল-আসাদও ক্ষমতা হারান। ফলে খামেনেয়ির আঞ্চলিক প্রভাব কিছুটা কমতে থাকে।
৮৬ বছর বয়সী খামেনেয়ি ১৯৮৯ সাল থেকে দেশ চালাচ্ছেন। রাষ্ট্রের সব শাখার চূড়ান্ত কর্তৃত্ব তার হাতে। নির্বাচিত নেতারা নিত্য প্রশাসনিক কাজ চালালেও যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরায়েল নিয়ে নীতিগত বড় সিদ্ধান্ত সবই খামেনেয়ির অনুমোদনে হয়।
কারনেগি এন্ডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের বিশ্লেষক করিম সাদজাদপুর বলছেন, ‘১৯৮৯ সালে শীর্ষ নেতা হিসেবে খামেনেয়ির নির্বাচিত হওয়া ছিল একরকম দুর্ঘটনা। প্রথমদিকের দুর্বল প্রেসিডেন্ট পরবর্তীতে একশ বছরের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী ইরানি নেতায় রূপ নেন।’
খামেনেয়ির নেতৃত্বে আদর্শিক কঠোরতা আর বাস্তবতার মিশেল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি সবসময় সন্দেহের চোখে দেখেন-বিশ্বাস করেন, তারা ইরানে শাসন পরিবর্তন চায়। কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে দরকার হলে তিনি দর কষাকষিতেও পিছপা হননি।
২০১৩ সালে তিনি ‘বীরের নমনীয়তা’ তত্ত্ব দেন—যার অর্থ, কখনো লক্ষ্য পূরণে কৌশলগত সমঝোতা করা যেতে পারে। ঠিক যেমন খোমেনি ১৯৮৮ সালে ইরাকের সঙ্গে আট বছরের যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছিলেন।
২০১৫ সালের ছয় জাতির সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি খামেনেয়ি সতর্কভাবে সমর্থন করেছিলেন, তার ধারণা ছিল নিষেধাজ্ঞা শিথিল হলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে, ফলে ক্ষমতাও আরও দৃঢ় হবে।
এ বছরের মার্চে ট্রাম্প খামেনেয়িকে চিঠি পাঠিয়ে নতুন চুক্তির প্রস্তাব দেন, আর হুমকিও দেন-কূটনীতি ব্যর্থ হলে সামরিক পদক্ষেপ হবে। তেহরান দাবি করে তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ, তবে পশ্চিমা বিশ্ব তা বিশ্বাস করে না। আর ইসরায়েল তো একে অস্তিত্বের হুমকি মনে করে।
খামেনেয়ি এর জবাব দেন তার চিরাচরিত ভঙ্গিতে—‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের শত্রুতা চিরকাল থাকবে। ওরা হামলার ভয় দেখায়, তবে যদি সাহস দেখায়, তার উপযুক্ত জবাব পাবে।’ আর দেশের ভেতরে বিশৃঙ্খলার চক্রান্ত হলে ‘জনগণই জবাব দেবে।’
খামেনেয়ি এমন এক কাঠামো গড়েছেন যাতে কেউ-কোনো গোষ্ঠী বা তার নিজের ঘনিষ্ঠ কেউও—তার অবস্থান বা যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারে।
ধর্মীয় মর্যাদার ঘাটতি পুষিয়ে নিতে তিনি ভরসা রেখেছেন নিরাপত্তা কাঠামোর ওপর। আইআরজিসি ও বাসিজ বাহিনী ব্যবহার করে বিরোধী কণ্ঠ চেপে রেখেছেন। বাসিজে লাখো স্বেচ্ছাসেবী সবসময় প্রস্তুত। খামেনেয়ির ক্ষমতা টিকে আছে ‘সেতাদ’ নামে বহু বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের ওপরও, যা তার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে বিস্তৃত হয়েছে।
ইরাক, লেবানন, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় প্রভাব বিস্তারে বিপুল অর্থ ঢেলেছেন। ২০০৯ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের বিক্ষোভ হোক বা ২০২২ সালে মাসা আমিনির মৃত্যুর পর ক্ষোভ-সবই কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে।
অনেকে তাকে একজন গোপন সংকীর্ণমনা আদর্শবাদী মনে করেন, যিনি সবসময় বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কায় থাকেন।
১৯৮১ সালে এক বোমা হামলায় তার ডান হাত আংশিক অচল হয়ে যাওয়ার পর থেকে এ মনোভাব আরও গভীর হয়।
তার জীবনী বলছে, মাত্র ২৪ বছর বয়সে শাহ বিরোধী বিক্ষোভে জড়িয়ে প্রথম কারাবন্দী হন। ইসলামি বিপ্লবের পর উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে ইরাক-ইরান যুদ্ধে বিপ্লবী গার্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। এই যুদ্ধে দুই পক্ষের সব মিলিয়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়।
পরবর্তীতে খোমেনির সমর্থনে তিনি প্রেসিডেন্ট হন। খোমেনির মৃত্যুর পর শীর্ষ নেতা হওয়ার ঘটনা এখনো অনেকের কাছে অবাক করা বিষয় হিসেবে বিবেচিত। তবে সেই ‘অপ্রত্যাশিত’ নেতাই আজ ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষের নাম-আয়াতুল্লাহ আলী খামেনেয়ি।