ফিলিস্তিনের ভূখণ্ড মূলত দুটি অংশে বিভক্ত- পশ্চিম তীর (ওয়েস্ট ব্যাংক) ও গাজা উপত্যকা (গাজা স্টাইপ)। আয়তনের দিক দিয়ে গাজা খুবই ছোট একটি অঞ্চল। এর আয়তন প্রায় ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার, যা গোটা ফিলিস্তিনি মূলভূখণ্ডের মাত্র ৬ শতাংশ। অপরদিকে, পশ্চিম তীরের আয়তন প্রায় ৫ হাজার ৮৬০ বর্গকিলোমিটার—অর্থাৎ গাজার তুলনায় প্রায় ১৬ গুণ বড়।
ভূমধ্যসাগরের উপকূলঘেঁষা এই এই ছোট্ট উপত্যকাটির দক্ষিণে মিশরের সিনাই উপদ্বীপ এবং পূর্বে ইসরায়েল। কিন্তু আয়তনের ক্ষুদ্রতা বা জনসংখ্যার ঘনত্ব গাজার কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতাকে কখনোই খাটো করতে পারেনি—বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটিই হয়ে উঠেছে ‘ফিলিস্তিন সংকটের প্রতীক’।
পশ্চিম তীর বর্তমানে ফিলিস্তিনের স্বীকৃত প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এখানেই রয়েছে রামাল্লাহ, যা ফিলিস্তিনের প্রশাসনিক রাজধানী। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস পশ্চিম তীরে তার ফাতাহ আন্দোলন-নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষ (প্যালেস্টেনিয়ান অথরিটি, পিএ) পরিচালনা করে থাকেন। তবে ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাসের বিজয়ের পর থেকেই গাজা ও পশ্চিম তীরের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন শুরু হতে থাকে। ২০০৭ সালে গাজা ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে নিয়ে নেয় হামাস, যার ফলে গাজা কার্যত ফিলিস্তিনি প্রশাসনের এক বিকল্প শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে।
গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাস ও পশ্চিম তীরের ফাতাহ নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্ক বরাবরই বৈরিতাপূর্ণ। ২০০৭ সালের পর থেকে গাজা ও পশ্চিম তীর আলাদাভাবে শাসিত হচ্ছে, এবং দুই দলের মধ্যে বারবার পুনর্মিলনের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে।
মাহমুদ আব্বাস পশ্চিমা ও আরব দেশগুলোর কাছে কূটনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও তার প্রশাসন দুর্বল ও জনসমর্থনহীন হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, হামাস মূলত সশস্ত্র প্রতিরোধ ও ইসলামপন্থী রাজনীতির ওপর ভর করেই গাজার নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে।
গাজার কৌশলগত গুরুত্ব: শুধুই প্রতিরোধ নয় গাজার তুলনামূলক ক্ষুদ্র আয়তন, অতিমাত্রায় ঘনবসতি (প্রায় ২৩ লাখ বাসিন্দা), এবং অর্থনৈতিক অবরোধ সত্ত্বেও এটি ফিলিস্তিন ইস্যুর কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে।
গাজা থেকে হামাস যেভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে, তা পশ্চিম তীরের প্রশাসনের তুলনায় অনেক বেশি তীব্র ও সরব। এতে হামাস সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
হামাস-ইসরায়েল সংঘর্ষ, বিমান হামলা, শিশু ও বেসামরিক নাগরিকের হতাহতের ঘটনা বারবার গাজাকেই বিশ্বসংবাদের শিরোনামে নিয়ে এসেছে।
২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল ও মিশরের যৌথ অবরোধের ফলে গাজা উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়, যা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে বিশ্বের উদ্বেগের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
এদিকে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর, হামাস ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ চালিয়ে ইসরায়েলের মূলভূখণ্ডের ভেতরে বড় পরিসরে হামলা চালায়। এতে ১২ শ’র বেশি ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হন এবং ২৫০ জনের বেশি বাসিন্দাকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। এর জবাবে ইসরায়েল ‘আয়রন সোর্ড’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে—যার মূল লক্ষ্য ছিল গাজা।
সেই হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েল গাজার ওপর ভয়াবহ বিমান হামলা ও স্থল অভিযান শুরু করে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক কোনো সংঘাত হয়ে দাঁড়ায়।
এখন পর্যন্ত গাজায় ৫৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন, লক্ষাধিক গৃহহীন হন, অবকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়।
গাজার ওপর ইসরায়েলের এমন বর্বরোচিত হামলা নতুন কিছু নয়। এর আগে ২০০৮-৯ সালে অপারেশন কাস্ট লিড, ২০১২ সালে অপারেশন পিলার অফ ডিফেন্স, ২০১৪ সালে অপারেশন প্রোটেকটিভ এজ এবং ২০২১ সালে শেইখ জাররাহ ইস্যুকে ঘিরে গাজায় ইসরায়েলি হামলা।
এসব হামলায়ও হাজারো গাজাবাসী নিহত হন। কিন্তু ২০২৩ সালের আগ্রাসনের মাত্রা, দীর্ঘতা ও ধ্বংসযজ্ঞ অতীতের সব হামলাকে ছাপিয়ে গেছে।
ইন্তিফাদা আন্দোলনে হামাসের ভূমিকা: ১৯৮৭ সালের প্রথম ইন্তিফাদা এবং ২০০০ সালের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় হামাস দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। বিশেষ করে সশস্ত্র প্রতিরোধের মাধ্যমে তারা ফিলিস্তিনি জনগণের একটি বড় অংশের আস্থা পায়, যারা ফাতাহ-নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের দুর্বলতা ও আপসনীতিতে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল।
ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের ঐতিহাসিক সংঘাত মূলত গোটা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে ঘিরে হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা কেবল গাজা-কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে।
ফাতাহ নেতৃত্বাধীন মাহমুদ আব্বাসের প্রশাসন ইসরায়েলের সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা বজায় রাখে, যার ফলে পশ্চিম তীর তুলনামূলক শান্ত। তবে ইসরায়েল পশ্চিম তীরে বসতি নির্মাণ অব্যাহত রাখলেও সেখানে হামাসের মতো কোনো সংগঠিত সশস্ত্র প্রতিরোধ নেই।
অন্যদিকে ফিলিস্তিনের এই ছোট্ট ভূখণ্ড গাজায় ইসরায়েল তার মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখে হামাসকে, ফলে সংঘাতের প্রবণতা এখানেই বেশি।
তবে পশ্চিম তীরেও মাঝে মাঝে সংঘর্ষ হয়, ২০২২-২৩ সালে জেনিন ও নাবলুসে ইসরায়েলি অভিযানে অনেক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তবে এগুলো ছিটেফোঁটা মাত্র, গাজার যুদ্ধপরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করলে এসব অভিযানে হতাহতের সংখ্যা খুবই কম।
ছোট আয়তন, অবরুদ্ধ বাস্তবতা, কট্টরপন্থি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর শাসন এবং ভয়াবহ মানবিক সংকট—সব মিলিয়ে গাজা আজ বিশ্বের সামনে দাঁড় করিয়েছে এক অসম প্রতিরোধ। ফিলিস্তিন সংকট এখন আর গোটা ভূখণ্ডের নয়, বরং গাজা এখন ফিলিস্তিনের এক প্রতীকী রূপ, যার রক্তে রঞ্জিত বাস্তবতা গোটা ফিলিস্তিনি জাতির বেদনার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।