অশান্ত মধ্যপ্রাচ্য। গাজা উপত্যকায় সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসকে নির্মূলের লক্ষ্য ইসরাইল অভিযান শুরু করা পর থেকেই দ্রুত বদলে যেতে থাকে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের দৃশ্যপট। হামাসের ঠিকানা মুছে দেয়ার যে মিশন নিয়ে ইসরাইলের হায়েনারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো নিরীহ মুসলিমদের ওপর, তা মোটেই হাসিল হয়নি।
লক্ষ্যপূরণ তো দূরের কথা, হামাসের একটি ঘাঁটিও খুঁজে বের করতে পারেনি বিলিয়ন ডলারে গড়া ইহুদের বিশেষায়িত বাহিনী আইডিএফ। জীবিত উদ্ধার করতে পারেনি একজন জিম্মিকেও। উল্টো এখন দৌড়ের ওপরে আছে ইসরাইলের সেনারা। এরিমধ্যে এক ডিভিশন সেনাকে সরিয়ে নিয়ে গাজা থেকে।
শুধ তাই নয়, গেল এক সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংঘাত আরও ছড়িয়ে পরেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছে একাধিক গোষ্ঠি। ফলে এই অঞ্চলে সংঘাত আরও ছড়িয়ে পরার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ে চলছে বিচার-বিশ্লেষণ। অনেকেই বলছেন তৈরি হতে পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি।
আসলেই কি তাই, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা বিবিসি। তাদের হিসাবে গেলো এক সপ্তাহে এক সঙ্গে ঘটে গেছে অনেকগুলো ঘটনা। সবশেষে ইরান-পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি হামলার বিরল ঘটনা। জঙ্গি দমনের কথা বলে এসব হামলার পর আপাতত দুই দেশ শান্ত থাকলেও, সামনের সময় ঘোলাটে।
ইটের বদলে পাটকেল ছোড়ার এই ঘটনাটি ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্যের মূল লড়াইয়ের কেন্দ্র ইসরাইল-গাজা থেকে অনেক দূরে। কিন্তু সীমান্তে এখন যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, আরো নতুন কোনো ঘটনা এক্ষেত্রে সংঘাত দ্রুত ছড়িয়ে দিতে পারে, যেমন জইশ আল আদল যদি ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলার সিদ্ধান্ত নেয়।
অন্যদিকে তপ্ত কড়াই হয়ে আছে লোহিত সাগর। হুথিদের আক্রমণ ঠেকাতে এসে ইয়েমেনে হামলা চালাচ্ছে আমেরিকা। কিন্তু তাতে ফল হয়েছে উল্টো। বাইডেনের যুদ্ধ জাহাজেই এখন হামলা চালাচ্ছে হুথিরা। তারা বলছে, এই পথ দিয়ে কাউকে ইসরাইলে যেতে হবে না। এখন পর্যন্ত কথা রেখেছে তারা।
এতে করে বিশ্ব বাণিজ্য বড় ধাক্কা খেয়েছে। বেড়েছে সমুদ্রপথে পণ্যপরিবহনের খরচ। এতে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে বহু দেশকে, বেশি দিচ্ছে পশ্চিমারা। আঁতে ঘা লাগায়, পশ্চিমা বেনিয়ারা পাগলের মতো আচরণ করছে। তাদের রক্ষক আমেরিকও বুঝে পাচ্ছে না, করণীয় কি।
ইয়েমেনে হামলা নিয়ে ব্যাকফুটে আছে আমেরিকাও। কারণ, ইয়েমেন স্বাধীর রাষ্ট্র, আর সেখানে হামলার কোন কারণও নেই। উল্টো হামলার মাধ্যমে হুথিদের পাল্টা হামলাকে বৈধতা দিলো বাইডেনের প্রশাসন। যার ফলশ্রুতি মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে দুইটি মার্কিন রণতরীতে সফল হামলা চালায় হুথিরা।
পশ্চিমারা সব সময়ই বলে আসছে হুথিদের খুঁটির জোর ইরান। পারমানবিক শক্তিধর দেশটির সরাসরি সমর্থন নিয়েই চলে হুথিরা। তবে তেহরান সরাসরি এনিয়ে কিছুই বলেনি। হুথিরা ক্রমাগত হামলা চালালে আমেরিকা বসে থাকবে না। আরও বড় হামলা চালালে তখন ইরানের জড়িয়ে পরাও শঙ্কাও তৈরি হয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্য ইরান-ইসরাইলের শত্রুতা নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক সময়ে তা নতুন গতি পেয়েছে। ইরাকে মোসাদ দপ্তর গুড়িয়ে দেয় ইরান। পাল্টা হিসাবে সিরিয়ায় ইরানি বিপ্লবী গার্ডের দপ্তর উড়িয়ে দেয় ইসরাইল। এতে করে চীর বৈরি দেশ দুটোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান ছায়াযুদ্ধ তীব্র রূপ নিয়েছে।
ইসরাইল-লেবানন সীমান্ত এই মুহূর্তে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকা। গত ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যেখানে নিয়মিতই গুলি ও ক্ষেপণাস্ত্র বিনিময় করছে ইসরাইল ও ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ। ফলে সামনের মাসগুলোতে উত্তরে যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা অতীতের থেকে এখন অনেক বেশি।
মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার সুযোগ নিয়েছে প্রায় বিলীন আইএস জঙ্গি গোষ্ঠি। বলা হচ্ছে মার্কিনরা এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে। ইরানকে বিরক্ত করতে আবারও দৃশ্যপটে আনা হয়েছে আইএসকে। এর ফলে গেলো সপ্তাহেই সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিতে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত একটি অঞ্চলে মিসাইল ছোড়ে ইরান।
সিরিয়া ঘিরে এখন প্রকাশ্যে সরব ইরান-ইসরাইল। সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে হামলা চালিয়ে ইরানের অভিজাত ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের উচ্চপদস্থ সদস্য হত্যা করে ইসরাইল। ইরান এর প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দেয়। মারাত্মক পাল্টা হামলা হলে যুদ্ধবেষ্টিত এই অঞ্চলে নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।
গাজায় ইসরাইল-হামাসের মধ্যে তীব্র লড়াই চলমান এবং এই যুদ্ধ এরইমধ্যে ১৬তম সপ্তাহে এসে পড়েছে। দক্ষিণের শহর খান ইউনিসে তাদের সর্বাত্মক অভিযানের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানায় তাদের সৈন্যরা যুদ্ধ শুরুর পর এই মুহূর্তে দক্ষিণের সবচেয়ে দূরবর্তী প্রান্তে পৌঁছে গেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের কসাই, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, এই যুদ্ধ ২০২৫ সাল পর্যন্ত চলতে পারে। ৭ অক্টোবরের হামলার স্মৃতি এখনো মুছতে না পারা ইসরাইলিদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। গাজায় যুদ্ধের পাশাপাশি পশ্চিম তীরেও সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে।
গেলো সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশ দ্বারা আরেক দেশে হামলার ঘটনা অন্যান্য কিছু অঞ্চলেও ঘটেছে। ইরাক ও সিরিয়ায় কুর্দি নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া জোটের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়েছে তুরস্ক। দেশটির একটা বিরাট অংশ কুর্দিশ সংখ্যালঘুর বসবাস এবং তুরস্ক তাদের সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে গণ্য করে।
একই সময়ে সিরিয়ার সীমান্তে বিরল বিমান হামলা চালিয়েছে জর্ডান। মাদক চোরাকারবারিদের টার্গেট করা হয় এই হামলা হয়েছে বলে দাবি করেছে দেশটি। আবার ইরাকে নিজেদের ঘাঁটি আক্রান্ত হওয়ায় আমেরিকা যদি পাল্টা ব্যবস্থা নেয়, তাহলে মাধ্যপ্রাচ্যে সংকট কোন দিকে যাবে, তা পরিস্কার হবে খুব শিগগরিই।