ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হলো দূরপাল্লার অস্ত্র যা ব্যালিস্টিক বা বাঁকা পথ অনুসরণ করে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এ ধরনের অস্ত্র পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করার জন্য মূলত তৈরি করা হয়।
ইসরায়েলি পারমাণবিক স্থাপনা এবং জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান ইসরায়েলের দিকে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে, যার মধ্যে কিছু ভূমিতে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনেছে।
যদিও ইসরায়েল অনেক আগত ক্ষেপণাস্ত্রকে প্রতিহত করেছে, তবে বেশ কিছু মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করেছে। যার ফলে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে ইসরায়েল ভূখণ্ডে। ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্রাগারের সঠিক আকার স্পষ্ট নয়, তবে এটিকে এই অঞ্চলের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে উন্নত হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলি কীভাবে কাজ করে?
শক্তিশালী রকেট ইঞ্জিন ব্যবহার করে উৎক্ষেপণ করা এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো অবিশ্বাস্যভাবে উচ্চ গতিতে বায়ুমণ্ডলের উপরের দিকে এমনকি মহাকাশেও উড়ে যায়।
ইঞ্জিনগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ক্ষেপণাস্ত্রটি একটি পূর্বনির্ধারিত পথ অনুসরণ করে, লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার আগে খাড়াভাবে পুনরায় প্রবেশ করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে।
নিক্ষেপ করার পর ক্ষেপণাস্ত্রটি সোজা উপরের দিকে উঠে দুই থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যায় মহাশূন্যে। এতে একাধিক রকেট যুক্ত করা যায়। প্রথম রকেটের জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে তা মূল ক্ষেপণাস্ত্র থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং দ্বিতীয় রকেটটি জ্বলতে শুরু করে। এভাবে একটি আইসিবএমে সাধারণত তিনটি পর্যন্ত রকেট যুক্ত করা হয়।
মহাশূন্যে পৌঁছে মাধ্যাকর্ষণকে কাজে লাগিয়ে অল্প সময়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ক্ষেপণাস্ত্রটি। এরপর আবার তা বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং লক্ষ্যবস্তু বা নিশানার উপর নেমে আসতে শুরু করে। পারমাণবিক বোমা যুক্ত একটি ক্ষেপণাস্ত্র চোখের নিমেষেই ধ্বংস করে ফেলতে পারে বিশ্বের যে কোনো শহর।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কতদূর যেতে পারে?
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কয়েকশ কিলোমিটার থেকে শুরু করে ১০ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে তাদের পাল্লার ওপর ভিত্তি করে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রের পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (বিআরবিএম): এ ধরনের মিসাইলের পাল্লা ২০০ কিলোমিটারের কম (১২৪ মাইল)।
স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (এসআরবিএম): এ ধরনের মিসাইলের পাল্লা এক হাজার কিলোমিটারের কম (৬২১ মাইল)।
মাঝারি/মধ্যবর্তী-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (এমআরবিএম/আইআরবিএম): এ ধরনের মিসাইল এক হাজার কিলোমিটার থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার (৬২১-২,১৭৫ মাইল) পাল্লার হয়ে থাকে।
দীর্ঘ-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (এলআরবিএম): এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার (২,১৭৫-৩,৪১৮ মাইল)।
আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম): এ ধরনের মিসাইল সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের বেশি (৩,৪১৮ মাইল) পাল্লার হয়ে থাকে।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কত গতিতে পৌঁছাতে পারে?
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র অত্যন্ত উচ্চ গতিতে ভ্রমণ করে, যা কয়েক মিনিটের মধ্যে হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিতে সক্ষম। এগুলো যে গতিতে ভ্রমণ করে তা ম্যাক-এ পরিমাপ করা হয়, যা শব্দের গতির সমতুল্য। উদাহরণস্বরূপ, ম্যাক ৫ মানে শব্দের গতির পাঁচ গুণ।
কিছু স্বল্প-পাল্লার, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সুপারসনিক গতিতে পৌঁছায়। এর গতি ম্যাক এক অথবা ১,২২৫ কিমি/ঘণ্টার থেকে বেশি কিন্তু ম্যাক ৫ এর তুলনায় কম। অন্যদিকে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র দীর্ঘ পাল্লার হয়ে থাকে। এগুলোর গতি ম্যাক ৫ এর চেয়ে বেশি। (৬,১২৫ কিমি/ঘণ্টা বা ৩,৮০৬ মাইল প্রতি ঘণ্টা)।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ইসরায়েলে পৌঁছাতে কত সময় লাগে?
ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ১,৩০০ কিমি থেকে ১,৫০০ কিমি (৮০০-৯৩০ মাইল)। ম্যাক ৫ বা ৬,১২৫ কিমি গতিতে ভ্রমণকারী ইরান থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রায় ১২ মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলে পৌঁছাতে পারে। যদিও সঠিক সময় ক্ষেপণাস্ত্রের ধরণ এবং উৎক্ষেপণ স্থানের ওপর নির্ভর করে।
ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে বাধা দেয়া কেন কঠিন?
দীর্ঘ পাল্লা ও উচ্চ গতির সক্ষমতা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর বিপজ্জনক হওয়ার অন্যতম কারণ। উচ্চ গতি পথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে প্রতিক্রিয়া জানাতে খুব কম সময় দেয় এবং যখন তারা বায়ুমণ্ডলে পুনরায় প্রবেশ করে, তখন তারা আরও দ্রুত নেমে আসে, যা বাধাদানকে আরও কঠিন করে তোলে। কিছু ক্ষেপণাস্ত্র রাডার এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাকে ফাঁকি দেয়ার জন্য ডিকয় বা অন্যান্য পাল্টা ব্যবস্থাও স্থাপন করে। ফলে তাদের বাধাদান করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য কী?
ইরান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করেছে বলে জানা গেছে। ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিপরীতে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পাইলটবিহীন বিমানের মতো হলেও এগুলো নিচু এবং স্থিরভাবে উড়ে যায়। ফলে ক্ষেপণাস্ত্রকে বিমান প্রতিরক্ষা অতিক্রম করতে সাহায্য করে। যদিও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের তুলনায় অনেক ধীর গতিতে ভ্রমণ করে ক্রুজ মিসাইল।
এ ধরনের মিসাইলগুলো বিমান প্রতিরক্ষাকে বাধাদানের জন্য আরও সময় দিলেও ভূমি ঘেঁষে অতিক্রম করার কারণে তাদের শনাক্ত করা কঠিন করে তোলে। এছাড়া ক্রুজ মিসাইল দিক পরিবর্তনও করতে পারে, যা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাতে ফাঁকি দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
ইরান থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রায় ১২ মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলে পৌঁছালেও, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সময় নেয় প্রায় দুই ঘণ্টা। এছাড়া ড্রোন নেয় ৯ ঘণ্টা সময়।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্রাগার
গত তিন দশক ধরে ইরান ব্যালিস্টিক এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের একটি পরিসর তৈরি করেছে। নীচের গ্রাফিকটিতে ইরানের কিছু বিখ্যাত ক্ষেপণাস্ত্র এবং তাদের পাল্লার সারসংক্ষেপ দেখানো হয়েছে।
ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্রাগার
ইসরায়েলের কাছে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্রাগার রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দূরপাল্লার এবং পারমাণবিক-সক্ষম সিস্টেম, যা কয়েক দশক ধরে তৈরি করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়। নীচের গ্রাফটি ইসরায়েলের কিছু উল্লেখযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র এবং তাদের নিজ নিজ পাল্লার ওপর আলোকপাত করে।
ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষমতা কী?
ইসরায়েলি বিমান প্রতিরক্ষা মূলত আয়রন ডোম সিস্টেম নামে পরিচিত যা একটি রাডার দিয়ে সজ্জিত। এটি আগত প্রজেক্টাইল শনাক্ত করে, সেইসঙ্গে এর গতি এবং দিকও শনাক্ত করে।
অন্যান্য সিস্টেম মাঝারি এবং দীর্ঘপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে বাধা দেয়। ডেভিড’স স্লিং ৪০ কিলোমিটার থেকে ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দেয় এবং ২৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্রকে বাধা দেয় অ্যারো সিস্টেম প্রযুক্তি।
সূত্র: আল জাজিরা