Thursday, July 10, 2025

বিবিসির অনুসন্ধানে ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশি হত্যাকাণ্ডের যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠলো

আরও পড়ুন

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে অন্তত ৫২ জন বিক্ষোভকারী নিহত হন বলে জানিয়েছে বিবিসি আই-এর একটি অনুসন্ধান। ওই দিনই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে টানা ৩৬ দিন চলা আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান। এই ঘটনার দিনটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ পুলিশি সহিংসতার দিন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

যাত্রাবাড়ীতে ৫ আগস্টের ভয়াবহ ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছিল, সেটি বের করার জন্য তখনকার শত শত ভিডিও, ছবি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য গ্রহণ এবং সেগুলো বিশ্লেষণের পাশাপাশি সরেজমিনে বেশ কয়েকবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিবিসি। তাদের অনুসন্ধানে ঐদিন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল, কত মানুষ হতাহত হয়েছিল সে সম্পর্কে এমন কিছু তথ্য ও বিবরণ উঠে এসেছে, যা আগে সবার সামনে আসেনি।

বিবিসি’র হাতে আসা ভিডিওতে ৫ আগস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিবর্ষণ শুরুর কিছু মুহূর্ত দেখা যায়। ভিডিওটি ধারণ করেন আন্দোলনকারী মিরাজ হোসেন, যিনি ঘটনাস্থলেই পরবর্তীতে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান।

পুলিশ যখন বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে, সেই সময়ের ভিডিও ধারণ করেছেন তিনি। মর্মান্তিকভাবে মোবাইল ক্যামেরায় ওই ভিডিওতে তার জীবনের শেষ মুহূর্তও ধরা পড়েছে। তার মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা তার মোবাইলটি খুঁজে পান এবং ফোনে সংরক্ষিত ভিডিওটি বিবিসিকে দেন।

আরও পড়ুনঃ  শুরুর ৪ দিনেই ৩ সুখবর, সবই পেলেন সরকারি চাকরিজীবীরা

ভিডিও’র মেটাডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেদিন বিকেল ২টা ৪৩ মিনিটে যাত্রাবাড়ী থানার মূল ফটকের সামনে হঠাৎ করেই পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানো শুরু করে।

ভিডিওটিতে যাত্রাবাড়ী থানার মূল ফটকে বিক্ষোভকারীদের সামনে সেনাবাহিনীর একটি দলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এরপর হঠাৎ করেই তারা ওই এলাকা থেকে সরে যান। এ ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই যাত্রাবাড়ী থানার ভেতরের পুলিশ সদস্যরা ফটকের সামনে অবস্থানরত বিক্ষোভকারী জনতার ওপর আকস্মিকভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করেন।

থানার উল্টো দিকে অবস্থিত একটি ভবনের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশ গুলি চালানো শুরু করার পর প্রাণ বাঁচাতে গলির ভেতর দিয়ে ছুটে পালাচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। ওই সময়ের আরেকটি ভিডিওতে আহতদের শরীরে লাথি মারতেও দেখা যায় পুলিশকে।

মিরাজের ধারণ করা ভিডিও থেকে হত্যাকাণ্ডটির সূত্রপাতের বিষয়ে স্পষ্ট একটা ধারণা পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে অন্য আরেক দিনের একটি ভাইরাল ভিডিওকে ভুলভাবে কীভাবে ৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ভিডিও বলে দাবি করা হচ্ছিলো তাও সামনে আসে।

বিবিসি অনুসন্ধানে জানা যায়, যাত্রাবাড়ী থানার ভেতর থেকে ধারণ করা সেই ভাইরাল ভিডিওটি ৫ আগস্টের বলে প্রচার করা হলেও সেটি আসলে সেদিনের পুলিশি সহিংসতার নয়, বরং অন্য কোনো দিন ধারণ করা হয়েছিল।

আরও পড়ুনঃ  মোটরসাইকেল রেজিস্ট্রেশন নিয়ে কঠোর নির্দেশনা

৫ আগস্ট ধারণ করা ভিডিওগুলোতে পুলিশকে যখন গুলিবর্ষণ করতে দেখা যায়, তখন যাত্রাবাড়ী থানা প্রাঙ্গণে তাদের একাধিক যানবাহন রাখা ছিল। সেখানে একটি সবুজ এবং সাদা রঙের গাড়ি দেখা যায়। কিন্তু ভাইরাল ভিডিওটিতে গাড়িগুলো নেই।

আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ভাইরাল ভিডিওটিতে ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলি চালানোর সময়ের নয়। বস্তুত সেটি আগের দিনের অর্থাৎ ৪ আগস্ট ধারণ করা ভিডিও ছিল।

ওই ঘটনার কিছু ভিডিও বিবিসি সংগ্রহ করেছে, যেখানে পুলিশকে থানা থেকে বেরিয়ে মহাসড়কের দিকে গুলি চালাতে যেতে দেখা যায়। সে সময় আন্দোলনকারীদের একজনের ধারণ করা ভিডিও’র গুলির শব্দের সঙ্গে ভাইরাল হওয়া ভিডিও’র গুলির শব্দের মিল খুঁজে পেয়েছে বিবিসি। আরও কিছু ফুটেজ বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হওয়া যায় ভাইরাল ভিডিওটি ৪ আগস্টের।

বিবিসির অনুসন্ধানে দেখা যায় ৫ আগস্ট বিকেলে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ৩০ মিনিটেরও বেশি সময় ধরে হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। ঘটনার সময়ের কিছু ড্রোন ভিডিও বিবিসি’র হাতে এসেছে।

ভিডিও’র মেটাডেটার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিকেল তিনটা ১৭ মিনিটেও যাত্রাবাড়ী থানার সামনের মহাসড়কে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাচ্ছিলো পুলিশ। এরপর তাদের বড় একটি দলকে থানার উল্টো পাশে অবস্থিত একটি অস্থায়ী সেনা ব্যারাকে আশ্রয় নিতে দেখা যায়।

আরও পড়ুনঃ  জিএম কাদের এখনো বাইরে কিভাবে, প্রশ্ন সারজিসের

ড্রোন ভিডিওতে মহাসড়কে হতাহতদের একাধিক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ভ্যান-রিকশা এবং বাইকে করে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন আন্দোলনকারীরা।

পরবর্তী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আন্দোলনকারীদের একটি অংশ শাহবাগের দিকে চলে যান। আর যারা তখনও যাত্রাবাড়ীতে ছিলেন, তাদের মধ্যে বিক্ষুব্ধ একটি অংশ থানায় আগুন দেন। এ ঘটনায় পুলিশের কমপক্ষে ৬ জন সদস্য নিহত হন।

সেদিন যাত্রাবাড়ীতে অন্তত ৩০ জন বিক্ষোভকারী নিহত হন বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়। তবে বিবিসির অনুসন্ধানে ৫ আগস্ট নিহতদের সংখ্যা ৫২ জন বলে নিশ্চিত করা হয়েছে।

এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা হয়েছে। এর মধ্যে থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসানের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে, যিনি হত্যাকাণ্ড চলাকালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে মেইল বার্তায় বিবিসিকে বাংলাদেশ পুলিশ জানায়, তারা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছেন।

এদিকে ঘটনার সময় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, তবে তাদের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এফএইচ

আপনার মতামত লিখুনঃ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ