বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের অভ্যন্তরে ২০০৯ থেকে ২০২৪-এ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে। গত কয়েক বছরে সংস্থাটিতে ছাত্রলীগ ক্যাডার, আওয়ামী পরিবারের সদস্য এবং ভারত অনুগতদের ব্যাপকভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে যে কোনো সময় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বড় ধরনের হুমকির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০০০-২০০১ ব্যাচের ১৩ কর্মকর্তার সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) মনজুরের সহযোগিতায় চলতে থাকে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ে ‘র’-এর পছন্দমতো লোক নিয়োগ।
নিয়োগের পর এসব কর্মকর্তার মধ্য থেকে ‘র’-এর বাছাই করা কিছু কর্মকর্তাকে ভারত থেকে বিশেষ গোয়েন্দা ট্রেনিং করিয়ে আনা হয়। এ প্রক্রিয়ায় বিপুলসংখ্যক এনএসআই কর্মকর্তাকে কয়েক দফায় ‘র’ ভারতে প্রশিক্ষণ করিয়ে এনে এনএসআইর গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন নিশ্চিত করে। ‘র’ এনএসআইর মাধ্যমে তাদের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করতে তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মনজুর আহমেদের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী বিটিভির সংবাদ পাঠিকা শিরিন শিলা ও ডিজির যৌথ মালিকানায় একটি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে এবং টিঅ্যান্ডটি বোর্ড থেকে ‘আইজিডব্লিউ’ লাইসেন্স নেয়।
এনএসআইয়ে ‘র’ নেটওয়ার্কএনএসআইয়ে ‘র’ নেটওয়ার্ক
এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের আড়ালে ‘র’-কে সুবিধা দেওয়া হয় এবং অবৈধ কার্যকলাপ আড়ালের লক্ষ্যে গুলশান টেলিফোন এক্সচেঞ্জের সুইচিং ও মিটারিং সিস্টেম বাইপাস করা হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে দায়সারা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় যার কার্যক্রম আজ পর্যন্ত অজানাই রয়ে গেছে। জানা গেছে, নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি ও কার্যকরী তথা শক্তিশালী করার লক্ষ্যে টিঅ্যান্ডটির বেশিরভাগ টেকনিক্যাল স্থাপনা গোপনে সংযুক্ত করে তা ‘র’-এর গোপন অপারেশনের কাজে ব্যবহার করা হয়। সামগ্রিক বিষয়টির গোপনীয়তার স্বার্থে এনএসআইর সিনিয়র পদে সশস্ত্র বাহিনী থেকে ‘র’-এর পছন্দ ও মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের প্রেষণে কিংবা সরকারি চুক্তিতে এবং বিধিবহির্ভূত বা সম্পূর্ণ অবৈধ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়। এই দুইয়ের সমন্বয়ে এনএসআই চলে যায় ‘র’-এর পুরোপুরি দখলে। বিষয়টি কার্যকর করার জন্য মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মনজুর আহমেদকে প্রথমে দুই বছরের চুক্তিতে এবং পরে তার চুক্তি পুনরায় একসঙ্গে তিন বছরের জন্য নবায়ন করা হয় অর্থাৎ তাকে এক নাগাড়ে পাঁচ বছর চুক্তিতে মহাপরিচালক রাখা হয় যা এনএসআইর ইতিহাসে নেই। এটা ‘র’-এর এনএসআই দখল ও তাদের অবস্থান সুসংহত করার নীলনকশার অংশ।
এনএসআইকে যেভাবে কবজায় নেয় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’এনএসআইকে যেভাবে কবজায় নেয় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’
এনএসআইর ভেতরে ‘র’ নিয়ন্ত্রিত আরো একটি গোপন এনএসআই সৃষ্টি করা হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে। ‘র’-এর অনুগত জনবল সময়ের বিবর্তনে এমন এক অবস্থানে এসেছে যে, বর্তমানে তারা এনএসআইর অতিরিক্ত পরিচালক পদ থেকে শুরু করে সব পদ ও গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য পদে দাপটের সঙ্গে পদায়িত। তাদের প্রোটেকশন দেওয়ার জন্য নিয়োজিত আছে সশস্ত্র বাহিনী থেকে প্রেষণে, সরকারি ও বেসরকারি চুক্তি এবং অবৈধ পন্থায় তথাকথিত নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের বেতন-ভাতাদি ‘সোর্স মানি’ থেকে মেটানোর পাশাপাশি তাদের জন্য গাড়ি, ড্রাইভার নিয়োগ ও সিকিউরিটি গার্ডও সোর্স মানি থেকে দেওয়া হচ্ছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে এনএসআই সিকিউরিটি গার্ড সংক্ষেপে ভারতের সঙ্গে মিল রেখে বলা হয় ‘এনএসজি’।
এনএসআইতে ২০০০-২০০১ ব্যাচের ১৩ কর্মকর্তা, যারা এইচটি ইমামের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রশাসনিক আদেশে নিয়োগপ্রাপ্ত তারা এবং ২০১২ সালে নিয়োগপ্রাপ্তদের ব্যাপারে ‘র’ সব সময় তৎপর ছিল এবং এখনো রয়েছে। ২০১২ সালের ব্যাচটি নেওয়ার পর এনএসআইতে ২০১৪, ২০১৬, ২০১৭, ২০২২ ও ২০২৩ মোট পাঁচটি ব্যাচ যোগদান করে। এদের বেশিরভাগই ছাত্রলীগের পদধারী ক্যাডার এবং আওয়ামী লীগ নেতা ও বিভিন্ন বাহিনীতে আওয়ামী কর্মকর্তাদের আত্মীয়-স্বজন। ২০০০-২০০১ ব্যাচের চিহ্নিত ‘র’-এর এজেন্ট হিসেবে পরিচিত দুজন যুগ্ম পরিচালক পরবর্তী সময়ে তাদের ভাই-ভাতিজাসহ মোট ১৪২ জন আত্মীয়-স্বজনকে এনএসআইতে চাকরির ব্যবস্থা করিয়েছেন।
পলাতক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের ভাতিজি নাহরিন চৌধুরী ২০২২ সালে লিখিত পরীক্ষায় ফেল করা সত্ত্বেও তাকে এনএসআইর সহকারী পরিচালক পদে চাকরিতে নেওয়া হয়। একই বছর তার স্বামী রুবাইয়েত ইমাম শোভনকেও সহকারী পরিচালক পদে চাকরি দেওয়া হয়। এই দুজনকেই স্ট্র্যাটেজিক শাখায় পদায়ন করা হয়। তার আরেক ভাতিজি তাহসিনা নাহলিন খানকে ২০২২ সালে এনএসআইতে চাকরি দেওয়া হয়। ২০২০ সালে এনএসআই নিয়োগ পরীক্ষায় পলাতক লে. জেনারেল (অব.) মুজিবের ভাতিজি ফারিয়া জামান মিশিতা মুজিবের গাড়িতে করে এসে বিকেলের পরীক্ষা সকালে দিয়ে চাকরি পান। মিশিতার স্বামী আসিফ ইবনে রশীদকেও একই বছর একই পদে চাকরি দেওয়া হয়। রশীদ ঢাকা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে কর্মরত ছিলেন।
আমার দেশ-এ জেনারেল মুজিবের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরপরই তড়িঘড়ি করে তাকে নিরাপদ স্থান হিসেবে ফেনীতে বদলি করা হয়। নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজের (২০১৪) ছেলে আবিদ রাব্বি মো. মুতাসিম বিল্লাহ ২০১৮ সালে এনএসআইতে উপপরিচালক হিসেবে চাকরি পান। তিনি স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালাইসিস বিভাগে কর্মরত। নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে এখন মামলা চলমান রয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর মেয়ে ফারাহ ফয়েজকে ২০২৩ সালে সহকারী পরিচালক পদে চাকরি দেওয়া হয়। এখন ফারাহ প্রশাসনিক বিভাগে কাজ করছেন। তাকে ২০২২ সালে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। পরে ২০২৩ সালে তাকে স্থায়ী করা হয়। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজের চাচাতো ভাই আল আমিনকে ২০২০ সালে সহকারী পরিচালক পদে চাকরি দেওয়া হয়। তাকে সাতক্ষীরার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জেনারেল আজিজের অনুরোধে সে সময় তার আত্মীয় আরো ১১ জনকে এনএসআইয়ের চাকরিতে নেওয়া হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের নাতি অনিক কামাল ও কামরুল হাসান ২০২০ সালে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন।
এনএসআইর নিয়োগ প্রক্রিয়া ধ্বংস হয় শেখ হাসিনার প্রথম আমলের শেষ সময় ২০০১ সালে। তখন থেকেই ছাত্রলীগ ক্যাডারদের ঢোকানো শুরু হয়।