Thursday, November 13, 2025

সেনাবাহিনীকে প্রতিপক্ষ করার নতুন এজেন্ডা রুখতেই হবে

আরও পড়ুন

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশি-বিদেশি প্রোপাগান্ডাবাজরা আবারও তৎপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়ে। গুজব-চক্রান্তে কুলাতে না পারলেও আশা ছাড়ছে না তারা। ‘যদি লাইগা যায়’ তত্ত্বে প্রায় প্রতিদিনই সেনাবাহিনী সম্পর্কে ছাড়া হচ্ছে কোনো না কোনো গুজববটিকা। কখনো সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের বা সেনাপ্রধানের সঙ্গে তাঁর অধস্তনদের কল্পিত বিরোধের কিচ্ছা ছড়ানো হচ্ছে মুখরোচক করে।

এবারের নির্বাচন একটি মহাঈমানি পরীক্ষা নির্বাচন কমিশনের জন্য। নির্বাচনের মুখ্য দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হলেও তা কেবল তাদের একার নয়। এখানে প্রার্থী, ভোটার, রাজনৈতিক দল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ অংশীজন অনেক। ইসি অনেকটা রেফারির মতো।

আর আম্পায়ারিংয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বলতে মানুষ আগে চেনে পুলিশকে। তারপর সেনা, র‌্যাব, বিজিবি, আনসার। বাস্তবতা হচ্ছে, পুলিশ এখনো ট্রমাগ্রস্ত।
গেল সরকার আমলে নানা ক্রিয়াকর্মে পুলিশ হয়ে যায় জনতার প্রতিপক্ষ। ঘৃণার ওই জায়গা থেকে পুলিশ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর বিপরীতে সেনাবাহিনী চলে এসেছে আরো ভরসা ও আস্থার জায়গায়। গেল সরকার নির্বাচনকালীন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকেই তাদের খারিজ করে দিয়েছিল। এবার আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২’ সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে আবারও অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা আর প্রয়োগকারীর মধ্যে বেশ ফারাক আছে। ভোট দেওয়া ভুলে যাওয়া মানুষের বিশ্বাস, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালনে সুফল আসবে। এই বিশ্বাস থেকেই ২০০১ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরপিও সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো বা সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ওই সংশোধনী অধ্যাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো বাদ দেয়। এবার সেখানে আশাবাদের খবর। মানুষ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে—এ আশা ও নিশ্চয়তা গণতন্ত্রকামী যে কারোর জন্যই অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত। তাই নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। আন্তর্জাতিক মহলও আশা করে, আমাদের আগামী জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে। ঢাকায় নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের কাছে এই প্রত্যাশার কথা জানান ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার। সর্বশেষ অফিসার অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও আগামী নির্বাচনে সেনা সদস্যদের আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন। এমন আশাবাদ ও উচ্চাশাকে ভণ্ডুল করতে নতুন উদ্যমে সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত, বিভ্রান্ত, উত্তেজিত করার ছক করেছে মহলবিশেষ।

আরও পড়ুনঃ  প্রায় এক দশক পর নতুন পে কমিশন সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি নিয়ে যা জানা গেল

প্রশ্নমুক্ত, অবাধ নির্বাচনের দাবি বা আশা তখনই আসে, যখন নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বা নাগরিক সমাজের মধ্যে উদ্বেগ থাকে। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনী ব্যবস্থা বা ভোটগ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যা ‘প্রশ্নহীন’ নির্বাচনের দাবিকে আরো জোরালো করে। স্বাধীনতার ৫৩-৫৪ বছরে এ দেশে ভোটের বহু মডেল প্রদর্শন হয়েছে। এখানে গণতন্ত্রের বহু মারপ্যাঁচ। একদলীয়, দ্বিদলীয়, কয়েক দলীয়, বহুদলীয় ইত্যাদি। ভোট আর নির্বাচনেরও এন্তার রকমফের! নামও অনেক। সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরপেক্ষ নির্বাচন, অবাধ নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ভোটেরও নানা নাম-চিহ্ন। ভোট ক্যু, মিডিয়া ক্যু, বাক্স লুটের ভোট, হ্যাঁ-না ভোট। সূক্ষ্ম কারচুপি, স্থূল কারচুপিরও নানা কলসাইন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচনে একটি মডেল দেখেছে মানুষ। ব্যালট বাক্স লুট থেকে শুরু করে দলের প্রায় সব প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণার নির্বাচনের ওই মডেল ভোটের জন্য আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর ইমেজে চরম আঘাত হানে। পছন্দের খন্দকার মোশতাককে জয়ী দেখাতে ব্যালট বাক্স কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এনে অধিকতর সঠিক ফলাফল দেওয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। এই সার্কাস শোতে আরো নতুনত্ব আসে জেনারেল এরশাদের জামানায়।

আরও পড়ুনঃ  সিসা বার খুলে দিতে তদবির, বুশরার স্বামী কে এই জাওয়াদ?

এতে প্রথম ব্যতিক্রম আসে এরশাদের পতনের পর ’৯১-তে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। স্বাধীন দেশে প্রথম স্বাধীন নির্বাচনের স্বাদ পায় মানুষ। এর মধ্যেই গণ্ডগোল পাকে তখনকার বিএনপি সরকারের মাগুরা ও মিরপুর উপনির্বাচনী মডেলে। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি মডেল। তারপর বিচারপতি হাবিবুর রহমান, লতিফুর রহমান, ফখরুদ্দীনদের তত্ত্বাবধায়ক জামানায় নির্বাচনের মোটামুটি একটি মডেল চলতে থাকে। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশে নির্বাচনী নাশকতা। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন অর্ধেকের বেশি এমপি। এরপর ২০১৮ সালে এসে দিনের ভোট রাতে সেরে ফেলার নতুন মডেল গড়ার অভিযোগ। চব্বিশে এসে ডামি-আমি। এবারের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা ভিন্ন। আগের সেই ভোটকাণ্ড অবসানের অপেক্ষা মানুষের। চলমান স্নায়ুযুদ্ধের এ সময় একতরফা কিছু করার সুযোগ এখন রুশ-উত্তর কোরিয়ার মতো কিছু দেশ ছাড়া আর কোনো দেশের নেই। সেই হিসেবে বাংলাদেশের সামনের নির্বাচন কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। নানা কারণে অনেকের চোখ বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের দিকে। বাংলাদেশ পাশের দেশ মায়ানমার নয়, দক্ষিণ এশিয়ার মালদ্বীপ নয়। আফ্রিকার গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ লাইবেরিয়াও নয়। তাই বিনা ভোটের ’১৪ নয়, রাতের ভোটের ’১৮ নয়। ’২৪-এর ডামি-আমি নয়। নির্বাচনকালীন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে সশস্ত্র বাহিনীকে ফিরিয়ে আনা প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনের আশাবাদে মাত্রা দিয়েছে। এমন আশাবাদ ও অপেক্ষার মাঝে ভরসার জায়গায় এখন সেনাবাহিনীকে নিয়ে নতুন চক্রান্ত। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নানা মন্তব্য ও আজগুবি তথ্য ছড়ানোর উদ্দেশ্য সরকারের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিরোধের ধারণা জন্ম দেওয়া। সর্বোপরি সেনাবাহিনীতে বিভাজন সৃষ্টি তথা নির্বাচন বানচালের অপপ্রয়াস। সেই সঙ্গে সেনাবাহিনীকে কমন প্রতিপক্ষ বানিয়ে গোলমাল বাধানো। সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত-উত্তেজিত-ক্ষিপ্ত করার হেন দাওয়াই নেই যা না ছড়ানো হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) অপব্যবহার মাত্রা ছাড়ানো আগ্রাসন চলছে সেনাবাহিনীকে নিয়ে।

ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় তুমুল উত্তেজনা চলছে, সেনাপ্রধানকে ঘেরাও করে ফেলা হয়েছে, জাহাঙ্গীরগেট এলাকায় যান চলাচল সীমিত করা হয়েছেসহ কত যে গুজব। ‘কী হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে? কাহিনি কী! খেলা কি শুরু হয়ে গেল? ওয়াকার কি চেয়ারে আছেন? —এ ধরনের প্রশ্নযুক্ত কত যে কনটেন্ট। প্রতিবেশী ভারতের কিছু গণমাধ্যম এসব ভুয়া নিউজের অপেক্ষাতেই থাকছে। ‘প্রধান উপদেষ্টাকে সেনাপ্রধান বা সেনাপ্রধানকে প্রধান উপদেষ্টা ক্ষমতা থেকে অপসারণের সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন’—এ ধরনের আজগুবি স্টোরি-কনটেন্ট তারা ছড়াচ্ছে নতুন আয়োজনে। ‘ইউনূসের বা ওয়াকারের বিদায়ের ক্ষণগণনা শুরু’ ধরনের শিরোনামযুক্ত মসলাও ছড়ানো হচ্ছে। সমতলের বিষয়ের সঙ্গে টেনে আনা হচ্ছে পাহাড়কেও। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, সেখানে নতুন করে সামরিক ক্যাম্প বসানো নিয়েও কল্পকাহিনির সিরিজ রটানো হচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ  তাজউদ্দীন কলেজের নাম পরিবর্তন করায় সোহেল তাজের প্রতিবাদ

নির্বাচন আরো ঘনিয়ে এলে এ ধরনের প্রোপাগান্ডা আরো তীব্র করার নমুনা স্পষ্ট। এ ছাড়া কোনো ছুঁতা বা প্রসঙ্গ ছাড়াও সেনাবাহিনীকে কটাক্ষ করার অভ্যাস কারো কারো মধ্যে রয়েছে। অনেকটা না বুঝে কিছু একটা বলে স্মাটনেস শো করাই তাদের বেশির ভাগের উদ্দেশ্য। তারা মনে করে, সেনাবাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নেগেটিভ কথা বলে ভাইরাল হওয়া যায়। সহজেই জনপ্রিয়তা আসে। তাঁরা ভুলে যান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন হতো না, যদি সেদিন বাঙালি সেনা সদস্যরা নিজেদের আত্মবলিদান না দিতেন। নব্বইয়ে এরশাদের পতন হতো না, তরুণ কর্মকর্তারা যদি সেদিন মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করতে অস্বীকার না করতেন। চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনারও এত সহজে পতন হতো না, যদি ছাত্র-জনতার পাশে সেনাবাহিনী না দাঁড়াত। কিন্তু প্রোপাগান্ডাবাজদের উদ্দেশ্য লার্জ স্কেলে। তাঁরা একদিকে ভেজাল বাধিয়ে প্রতিশোধপাগল। অন্যদিকে চব্বিশের পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনীর জনসম্পৃক্ততার অনন্য দৃষ্টান্তকে বানচাল করতে চায়। আরেক দিকে চায় নির্বাচন বানচালসহ গোটা দেশে একটি অরাজকতা। কেউ দেশে, কেউ ভিনদেশে বসে এ অপকর্মে যুক্ত হচ্ছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার কথা ভিন্ন। কারণ তাদের কোনো সম্পাদকীয় কর্তৃপক্ষ নেই। দায়বদ্ধতা নেই। হিট বা ভাইরাল হতে গিয়ে নিজের সম্পর্কে অশ্রাব্য শব্দ-বাক্য ব্যবহারেও তাদের বাধে না। সেখানে দেশের সর্বনাশ তাদের কাছে কোনো বিষয়ই নয়।

আপনার মতামত লিখুনঃ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ