Sunday, July 6, 2025

নবীন শিক্ষার্থীদের র‌্যাগিং—বাবা-মা নিয়ে গালি, প্রোপোজ করানো হয়েছে ‘আপুদের’

আরও পড়ুন

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) নৃবিজ্ঞান বিভাগের ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের কয়েকজন নবীন শিক্ষার্থীকে র‍্যাগিং ও মানসিক হয়রানির অভিযোগ উঠেছে সিনিয়রদের বিরুদ্ধে। মা-বাবাকে নিয়ে গালি দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এতে আতঙ্কে একাধিক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সিনিয়ররা এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, তাদের নিয়ে চা পানের পাশাপাশি উচ্চস্বরে কথা হয়েছে, র‌্যাগিং হয়নি।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ক্লাস শুরুর প্রথম দিন থেকেই পরিচয় পর্বের আড়ালে শুরু হয় মানসিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে এক নবীন শিক্ষার্থী কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ ছাড়াও টানা তিনদিন নবীন শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে ডেকে নিয়ে র‍্যাগ দেয়া হয় বলে জানা গেছে। এর মধ্যে বেঞ্চে তুলে দাঁড় করানো, হলে নিয়ে সিগারেট খেতে দেয়া, সিনিয়র আপুকে প্রপোজ করানো, নির্জন স্থানে নিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও বাবা-মায়ের নামে অশালীন ভাষায় গালমন্দ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভাগ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুক্তভোগী এক নবীন শিক্ষার্থী জানান, ২ জুলাই রাতে বিভাগের ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ (সিআর) তাকে সিনিয়রদের সঙ্গে দেখা করাতে ‘তালতলা’ নামক নির্জন স্থানে নিয়ে যান। সেখানে সিনিয়ররা মো. ওয়ালি উল্লাহ, রাফিও হাসান, অরবিন্দু সরকার, তাকে ও তাঁর বন্ধুদেরকে অশ্লীল গালাগাল করে এবং মায়ের নামে কুরুচিপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করেন। মোবাইল রেখে দীর্ঘ সময় আটকে রাখার পর রাত ১টায় ছাড়া হয়। পরদিন (৩ জুলাই) আবার ডেকে নেয়া হয় একই স্থানে এবং ছবি তুলে রাখাসহ নানা অপমানজনক আচরণ করা হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি।

আরও পড়ুনঃ  ছাত্রী মোটা না চিকন হয়েছে দেখতে ইমোতে কল দেন ইবি শিক্ষক!

ক্লাস শুরুর প্রথম দিন থেকেই পরিচয় পর্বের আড়ালে শুরু হয় মানসিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে এক নবীন শিক্ষার্থী কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ ছাড়াও টানা তিনদিন নবীন শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে ডেকে নিয়ে র‍্যাগ দেয়া হয় বলে জানা গেছে। এর মধ্যে বেঞ্চে তুলে দাঁড় করানো, হলে নিয়ে সিগারেট খেতে দেয়া, সিনিয়র আপুকে প্রপোজ করানো, নির্জন স্থানে নিয়ে ভয়ভীতি প্রদর্শন ও বাবা-মায়ের নামে অশালীন ভাষায় গালমন্দ করা হয়েছে।

ভুক্তভোগী আরও জানান, তাকে জোর করে সিগারেট খেতে বলা হয়। এমনকি বলা হয়, ‘তোরে দেখতে গাঁজাখোরের মতো লাগে।’ পাশাপাশি এক সিনিয়র আপুকে কল দিয়ে প্রপোজ করতে বাধ্য করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, ‘সিনিয়র ভাই আমার মাকে নিয়েও কুরুচিপূর্ণ ভাষায় গালাগাল করেছেন।’

আরেক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘ওরিয়েন্টেশনের দিন আমি সিনিয়রদের বলি, নতুন বাংলাদেশে আপনারা চাইলে নিজেদের সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারতেন। আপনাদের আচরণের কারণে একজন মেয়ে কান্না করেছে, এটা ঠিক হয়নি।’ এ প্রতিবাদের কারণে আমাকে টার্গেট করা হয়। পরবর্তীতে প্রথম ক্লাসের দিন তারা আমাকে এবং আমার মাকে নিয়ে গালাগাল করেন। পাশাপাশি ১০ বার সালাম দিতে বাধ্য করেন। এরপর আবার বেঞ্চের ওপরও দাঁড় করে রাখেন।

ঘটনার পর ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থী নারায়ণগঞ্জে নিজ বাড়িতে চলে যান। দু’দিন পর শুক্রবার (৪ জুলাই) সন্ধ্যায় মেসে ফিরে ক্যাম্পাসে হাঁটতে গেলে ব্যাচের সিআর এক সিনিয়র ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে বলেন বলে জানান। তাকে ডেকে নেওয়া হয় নজরুল হলের ১০৯ নম্বর কক্ষে। সেখানে বলা হয় ‘তুই নাকি র‍্যাগিং কালচার পরিবর্তন করতে চাস?’ এরপর ফের তাকে গালাগাল ও হুমকি দেওয়া হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি ছাড়া পান। এ সময় তাকে আবার র‍্যাগিং দেয় রাফিও হাসান ও মো. ওয়ালি উল্লাহ।

আরও পড়ুনঃ  এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিসিএস ক্যাডার হলেন ৬০ জন

অভিযুক্তদের মধ্যে অরবিন্দু সরকার, মো. অলি উল্লাহ, রাফিও হাসান নজরুল হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। এছাড়া মোনতাসীর বিল্লাহ পাটোয়ারী বিজয় ২৪ হল এবং বাকি দুই ছাত্রী মেসে থাকেন বলে জানা গেছে।

র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে অভিযুক্ত মো. অলি উল্লাহ বলেন, ‘আমি র‍্যাগিংয়ের সঙ্গে জড়িত না। আমি শুধু ওদেরকে দক্ষিণ মোড়ে চা খাওয়ানোর জন্য ডেকেছিলাম।’ তবে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ‘অলি উল্লাহ এবং তার বন্ধু রাফিও হাসান নবীন শিক্ষার্থীদের দিয়ে সিনিয়রদের আপুকে কল দিয়ে প্রপোজ করতে বলেন এবং নজরুল হলের ১০৯ নম্বর রুমে ডেকে নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। ‘তালতলা’ নামক স্থানে র‍্যাগ দেওয়ার সময়ও অলি উল্লাহ ও অরবিন্দু সরকার উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অরবিন্দু সরকার বলেন, ‘ওদের সাথে গেটে দেখা হলে আমরা শুধু চা খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা কাউকে র‍্যাগ দিইনি, এমন কিছু ঘটেনি।’ তবে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, ‘সিআর’র মাধ্যমে তাকে ডেকে নিয়ে র‍্যাগ দেওয়া হয় এবং অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করা হয়।

রাফিও হাসান অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি তাকে সাথে নিয়ে আপনার সাথে দেখা করতে চাই। আমার সাথে দুইজন জুনিয়র হলে গেছে। তবে র‍্যাগিংয়ের অভিযোগটা মিথ্যা।’ তবে প্রতিবেদকের হাতে থাকা ১৩ মিনিটের একটি অডিও রেকর্ডিংয়ে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

আরও পড়ুনঃ  আঙ্গুল উঁচিয়ে ভিসিকে শিক্ষার্থী—‘স্যার, আপনি নিজের যোগ্যতায় আসেননি, আমরা বসাইছি’, কী সাংঘাতিক!

অভিযুক্ত এক ছাত্রী বলেন, ‘এই ধরনের কিছু করা হয়নি। সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। কেউ একজন আপনাকে কিছু বলেছে, আর আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন। আমি কিছু করিনি।’

এছাড়াও অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের পর একই ব্যাচের আরও দুইজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে জুনিয়রদের সাথে উচ্চবাচ্য করার অভিযোগ রয়েছে। তারা হলেন, মোন্তাসির বিল্লাহ ও এক ছাত্রী। এ বিষয়ে সিনিয়র ছাত্রী বলেন, ‘আমরা শুধু আড্ডা দিচ্ছিলাম। এরকম কিছুই হয়নি। ওরিয়েন্টেশনের দিন শুধু একটু জোরে কথা বলা হয়েছিল, কিন্তু সেটা র‍্যাগিং নয়।’

মোন্তাসির বিল্লাহ পাটোয়ারী র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা কাউকে র‍্যাগ দেইনি। তবে ওরিয়েন্টেশনের দিন আমার এক নারী বন্ধু হয়তো জুনিয়রদের কিছু বলেছিলেন, যার ফলে এক মেয়ে কেঁদে ফেলেছিল। তবে সে ঠিক কী বলেছিল, তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।’

এ বিষয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক শামীমা নাসরিন বলেন, ‘প্রশাসন র‌্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে যেভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সে পথেই এগোব। আমাদের প্রতিষ্ঠানে র‌্যাগিং প্রতিরোধে প্রশাসনিক যে নীতিমালা ও ব্যবস্থা রয়েছে, তার মাধ্যমেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হাকিম বলেন, ‘আমি বিষয়টি এইমাত্র জানলাম। বিভাগীয় প্রধানের সাথে কথা বলব। পরবর্তী অ্যাকাডেমিক মিটিংয়ে বিষয়টি উত্থাপন করা হবে।’

আপনার মতামত লিখুনঃ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ