Tuesday, July 29, 2025

ডিএমপির ক্ষমতাধর ওসি ইফতেখার হোটেল থেকে ফুটপাত, পান সবখান থেকেই চাঁদার ভাগ মোহাম্মদপুর থানা

আরও পড়ুন

মোহাম্মদপুর থানা এলাকার বুড়িগঙ্গা পাম্পে গত বছরের নভেম্বরে অভিযান চালিয়ে ম্যানেজারের কক্ষ থেকে বিদেশি পিস্তল, গুলিসহ দুজনকে আটক করেন সেনাসদস্যরা। এ ঘটনায় পাম্পের মালিক শামিম বেপারিকে প্রধান আসামি করে থানাকে মামলা করতে বলে সেনাবাহিনী। তবে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে ফোন করে ঘটনাস্থলে পাওয়া না যাওয়ায় শামিম বেপারিকে আসামি করা যাবে না বলে জানান। এরপর প্রধান আসামিকে বাদ দিয়ে মামলা করেন ওসি। শুধু তাই নয়, হাতেনাতে অস্ত্রসহ আটকদের আনা হয়নি রিমান্ডে। অভিযোগ রয়েছে, মামলা থেকে নাম বাদ দিতে শামিম বেপারির কাছ থেকে অন্তত ৪০ লাখ টাকা নেন ওসি। তবে এ ধরনের ঘটনা একটিই নয়, বরং মোহাম্মদপুরের নিত্যদিনের চিত্র। অভিযানে জব্দ ১০ লাখ টাকার হেরোইন মামলার নথিসহ থানা থেকে গায়েব আবার বাসা থেকে ডেকে এনে মাদক মামলায় ফাঁসানো, এজাহার লিখে আসামিদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে মামলা নথিভুক্ত না করা, এমনকি চাহিদামাফিক টাকা না দেওয়ায় ব্যবসায়ীর দোকান বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। অনেক ভুক্তভোগী অভিযোগ জানাতে গিয়ে উল্টো থানার ভেতরেই হয়রানির শিকার হয়েছেন। এমন সব ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে মোহাম্মদপুরের বাসিন্দারা অন্তত ১০বার থানা ঘেরাও করে ওসির অপসারণ চেয়ে মানববন্ধন করেছেন। আর এতসব সুনির্দিষ্ট অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, সেই মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ আলী ইফতেখার হাসান নিজেকে দাবি করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী ওসি হিসেবে। ভূরিভূরি অভিযোগ নিয়ে ওসি ইফতেখার বহাল তবিয়তে থাকলেও গত রোববার রাতে ক্লোজ (দায়িত্ব থেকে সরানো) করা হয়েছে পরিদর্শক (তদন্ত) হাফিজুর রহমানকে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিএমপির একজন অতিরিক্ত কমিশনারের নিজ এলাকার লোক ওসি ইফতেখার। ওই অতিরিক্ত কমিশনার ডিএমপির প্রশাসন শাখায় থাকায় তাকে দিয়েই গত রোববার রাতে কোনো তদন্ত ছাড়াই বদলি করান পরিদর্শক তদন্তকে। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, ওই অতিরিক্ত কমিশনারের খুঁটির জোরেই ভূরিভূরি অভিযোগ থাকার পরেও বহাল তবিয়তে রয়েছেন ওসি আলী ইফতেখার হাসান।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা পাম্পটি বর্তমানে শামিম বেপারি নামে একজন পরিচালনা করছেন। তার ভাই শাহিন বেপারি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। তিনি বর্তমানে পলাতক থাকায় পাম্পটি তার ভাই শামিম বেপারি দখলে নিয়েছেন। অন্য কেউ যাতে দখলে নিতে না পারে সেজন্য পাম্প পাহারা দিতে অস্ত্রসহ দুজনকে নিয়োজিত রেখেছিলেন শামিম বেপারি।

জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর সেনাক্যাম্পের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে বুড়িগঙ্গা পাম্প থেকে অস্ত্রসহ দুজনকে আটক করা হয়। এরপর পাম্পের মালিক শামিম বেপারিকে এক নম্বর আসামি করে মামলা করতে বলে আটকদের থানায় হস্তান্তর করি। পরে ওসি ফোন করে জানায়, শামিম বেপারিকে ঘটনাস্থলে পাওয়া না যাওয়ায় তাকে আসামি করা যাবে না। পরে আমরা কিছু বলি নাই। ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তাকে খুঁজছি, কখনো আটক করতে পারলে তখন দেখব।’

গত ৫ মার্চ রাতের ঘটনা। কালবেলার হাতে থাকা একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, মোহাম্মদপুর থানার পরিদর্শকের (অপারেশন) নেতৃত্বে এসআই মোশারফ, এসআই মাইদুল, এসআই আলতাফ, পরিদর্শকের (অপারেশন) দেহরক্ষীসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য অভিযান চালায় মোহাম্মদপুরের তিন রাস্তার মোড় এলাকায়। সেখানে গিয়ে ‘কাচ্চি খান’ নামে একটি দোকান বন্ধ করে দেন তারা। কাচ্চি খানের স্বত্বাধিকারী মো. জুয়েল কালবেলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, রাতে দোকান খোলা রাখলে থানা পুলিশকে দিতে হয় মাসোহারা। সেটি না দিলেই দোকানপাটে পুলিশ পাঠিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, গত ৬ মে রাতে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে মো. সাদ্দাম ওরফে ম্যানেজার সাদ্দাম (৩৫) নামে এক মাদক কারবারিকে ১০ লাখ টাকা মূল্যের ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ আটক করে পুলিশ। সেদিন মধ্যরাতে অর্থাৎ ৭ মে সাদ্দামের বিরুদ্ধে একটি মামলার এফআইআর ড্রাফট (খসড়া) করা হয়। সেই মামলার প্রাথমিক বিবরণীর ড্রাফট, সাধারণ ডায়েরি, আসামি চালানসহ প্রয়োজনীয় সব নথি প্রস্তুত করা হয়। সকাল ৭.১৯ মিনিটে ‘টিম মোহাম্মদপুর পিএস’ নামে থানার একটি গ্রুপে ডিউটি অফিসার এসআই শামিম সেই ড্রাফটি শেয়ার করেন। সঙ্গে ক্যাপশনে লেখেন, ‘এসআই রাজু ১ জন আসামি গ্রেপ্তার আছে। ফরওয়ার্ডিং দিবেন।’

আরও পড়ুনঃ  তবে এবার আর নীরব থাকেনি জনতা ও পুলিশ, ঘটতে দেয়নি আরেকটি ঘটনা!

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কোনো মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিলে তার ফরওয়ার্ডিং লাগে। এরপর এসআই রাজু ফরওয়ার্ডিং দিতে গিয়ে জানতে পারেন সেই মামলা হবে না। বরং আসামিকে পুরোনো মামলায় চালান করা হবে।

বিষয়টি নিয়ে গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে খোঁজ নিয়েছে কালবেলা। পুলিশের একাধিক সূত্র থেকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত হওয়া গেছে। উদ্ধার করা হয়েছে ১০ লাখ টাকার হেরোইন মামলা গায়েবের সমস্ত আলামত।

কালবেলার হাতে থাকা বিভিন্ন আলামত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মোহাম্মদপুর থানার জেনেভা ক্যাম্প এলাকা থেকে ১০ লাখ টাকার ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ সাদ্দামকে আটক করে থানায় নিয়ে আসা হয়। এই ঘটনায় করা মামলার বাদী মোহাম্মদপুর থানার এসআই মো. শাখাওয়াত হোসেন এবং মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় এসআই রাজু আহমেদকে। সেই মামলাটি (মামলা নং-২৪) মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ২০১৮ এর ৩৯ (১) এর ৮(গ) দেয়া হয়। তবে আদালতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৭ মে তারিখের ওই ২৪/৪৪৩ নম্বর মামলাটি একটি ছিনতাই মামলা। এতে মামুন হোসেন নামে একজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মোহাম্মদপুরের রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের পাশে ডিউটিরত ছিলেন এসআই আলতাব, এসআই সাখাওয়াত, এএসআই সাত্তারসহ আরও একজন কনস্টেবল। তারা জানতে পারেন, জেনেভা ক্যাম্পে একজনকে মারধর করে আটকে রাখা হয়েছে। সেখান থেকে এসআই সাখাওয়াত ও এএসআই সাত্তার তাকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসেন। ওই সময় তার কাছে কোনো হেরোইন পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ওসির নির্দেশে তার ঘনিষ্ঠ এসআই আলতাফ ১০০ গ্রাম হেরোইন দিয়ে চালান করার জন্য একটি এফআইআরের ড্রাফট, মামলার নম্বর, জিডি, আসামি চালানের কপি তৈরি করেন।

মামলার এফআইআর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ৬ মে রাতে জেনেভা ক্যাম্পের বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করে রাত ১২টা ৪০ মিনিটে একটি প্রাথমিক তথ্য বিবরণী (এফআইআর) লেখা হয়। তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৮ সালের ৩৬ (১) ধারার ৮ (গ) উপধারায় মামলা প্রস্তুত করা হয়। প্রাথমিক তথ্য বিবরণীর কপিতে দেখা যায়, বাঁ পাশে বিপি ফরম নং ২৭ ও বাংলাদেশ ফরম নং ৫৩৫৬ উল্লেখ করা। এ ছাড়াও, কপিটির ঠিক মাঝখানে প্রাথমিক তথ্য বিবরণী লেখাটির নিচে নিয়ন্ত্রণ নং ২৪৩ এবং থানায় পেশকৃত ফৌজদারি বিধান কোষের ১৫৪ নং ধারায় ধাতব্য অপরাধ সংক্রান্ত প্রাথমিক তথ্য লেখা রয়েছে। যে কাগজটিতে ঘটনার তারিখ ও সময় হিসেবে ৬ মে রাত ২৩ টা ৪০ মিনিট উল্লেখ করা আছে। পাশাপাশি, পরদিন ৭ মে ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ আসামিকে আদালতে পাঠানোর জন্য মোহাম্মদপুর থানার আসামি চালান কপি প্রস্তুত করে আসামির নাম লিপিবদ্ধ করা হয়। যে চালান কপিতে সাদ্দাম হোসেনের নাম ৩ নম্বর সিরিয়ালে লেখা রয়েছে। এতে তার পিতার নাম আকবর, মামলা নম্বর ও ধারা এবং তদন্তকারী কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আসামিকে আদালতে পাঠানোর চালান কপিতে লেখা, আসামি চালান নং-২৫। কপিটির ডান পাশে লেখা ৩৯২৪৩ হারুন ও ১৮০১৩ রাকিবুল। একই চালান কপিতে দুই নম্বর সিরিয়ালের আসামির নাম মো. দেলোয়ার হোসেন এবং ৪ নম্বর আসামি জনি ইসলাম। তবে সাদ্দামের নাম পরে কেটে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও, গ্রেপ্তার হওয়া আসামিকে আদালতে পাঠানোর জন্য একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। সাদ্দামকে আদালতে পাঠানোর জন্য সে জিডি সম্পন্ন করে তা রেজিস্ট্রার বইয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়। যে বইটিতে জিডি নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে ৫০০। এ জিডিটি ৭ মে রাত ১২টা ৪০ মিনিটে লিপিবদ্ধ করা হয়। জিডির নম্বর দেওয়া এ বইটির বাম পাশে লেখা- বিপি ফরম নং- ৬৫, বাংলাদেশ ফরম নং ৫৩৬৫। বইটির মাঝখানে সাধারণ ডায়েরি বহি লেখা রয়েছে। ঠিক তার নিচে নিয়ন্ত্রণ নং ৩৭৭ লেখা আছে এবং এক পাশে ৯২৫৩২৮ পৃষ্ঠা নাম্বার লেখা রয়েছে। তবে রহস্যজনক কারণে এতসব আয়োজনের পরেও আসামি সাদ্দামকে হেরোইন মামলায় চালান না করে পুরোনো একটি মামলায় আদালতে পাঠানো হয়। পরোয়ানাতে দেখা যায়, মোহাম্মদপুর থানার মামলা নং ১০ (১১) ২৩ এবং জিআর নং ১৬৬৬/২৩ লেখা রয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  ক্লাস ক্যাপ্টেন তানভীর এখন শুধুই সংখ্যা

অন্যদিকে, বাসা থেকে ডেকে এনে জেনেভা ক্যাম্পের সৈয়দপুরিয়া বাবু নামে একজনকে ১০০ গ্রাম হেরোইন দিয়ে চালানের অভিযোগ রয়েছে ওসি ইফতার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। জানতে চাইলে বাবুর ভাই হোসেন মোহাম্মদ আজাত কালবেলাকে বলেন, ‘আমার ভাইকে বাসা থেকে কাদেরিয়া মাদ্রাসার গলির সামনে ডেকে এনে আটক করে। তখন ওর কাছে কিছুই পায়নি পুলিশ। বাবুর বিরুদ্ধে ক্যাম্পে মারামারির ঘটনার মামলা রয়েছে। এরপর আমরা থানায় গেলে ওসি ২০ লাখ টাকা দাবি করে বলে, টাকা দিলে মারামারির ঘটনায় হওয়া পুরোনো মামলায় চালান দেবে। নতুন করে কোনো মামলা দেবে না। তবে আমরা এত টাকা দিতে না পারায় গত ১৬ এপ্রিল ১০০ গ্রাম বা ১০ লাখ টাকার হেরোইন দিয়ে মামলা দেয়।’

হোসেন মোহাম্মদ আজাতের বক্তব্যের সত্যতা মেলে কালবেলার হাতে থাকা একটি ভিডিওতে। সেখানে দেখা যায়, মোহাম্মদপুর থানার বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য বাবুকে আটকের পরে তাকে ধাপে ধাপে তল্লাশি করে। তবে ওই সময় তার কাছে কিছুই পাওয়া যায়নি। এরপর বাবুকে একটি মোটরসাইকেলের মাঝখানে বসিয়ে নিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, মোহাম্মদপুর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী এজাজকে সেনাবাহিনী আটক করে থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে এ রকম একজন ভয়ংকর শীর্ষ সন্ত্রাসীকে একটি ডাকাতির প্রস্তুতি মামলায় চালান করেন ওসি। যে কারণে সেদিনই জামিন নিয়ে বের হয়ে যায় এজাজ। পরে আবার রাতে তাকে ডিবি পুলিশ আটক করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় এজাজ। একাধিক মামলা থাকার পরও এ রকম একজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ডাকাতির প্রস্তুতি মামলায় চালান করায় বিস্ময় প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া সম্প্রতি মোহাম্মদ নামে একজনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আরও একটি হত্যাচেষ্টা মামলার এজাহার তৈরি করা হয়। সেখানে একটি জাতীয় দৈনিক ও একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের এক সাংবাদিককে আসামি করা হয়। তবে মামলা হয়নি। মামলা না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে নূর মোহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমি যেসব আসামি দিয়েছিলাম, এজাহারে দেখি তার চেয়ে বেশি। কিছু নাম আনফরচুনেটলি (দুর্ভাগ্যবশত) ঢুকে গেছে, যে কারণে আমি মামলা করি নাই।’ জানা গেছে, প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে ওই সাংবাদিকদের নাম ওসি এজাহারে দিয়েছিলেন। তবে বিষয়টি ওই সাংবাদিকরা জেনে যাওয়ার পর পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে সেই মামলা হয়নি।

যত অভিযোগ: স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার চার উপপরিদর্শক (এসআই) ও এক পরিদর্শক নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এ চক্রে রয়েছেন এসআই আলতাফ, মল্লিক, মাহিদুল ও মোশারফ এবং পরিদর্শক (অপারেশন)। তারাই নির্ধারণ করেন মোহাম্মদপুর থানায় কে গ্রেপ্তার হবে, কাকে কখন আটক করতে হবে, কাকে আটক করে ছেড়ে দিতে বা কাকে কখন ধরে কোন মামলায় চালান করতে হবে। মোহাম্মদপুর এলাকায় থাকা আবাসিক হোটেল, টাউনহল বাজার, মীনা বাজার, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে ৩ রাস্তার মোড় পর্যন্ত ফুটপাত ও ব্যবসায়ীদের থেকে দৈনিক এবং মাসিক হিসেবে চাঁদা আদায় করা হয়। এসব চাঁদা বিভিন্ন হাত হয়ে পৌঁছে যায় ওসির পকেটে। কেউ যদি রাত ১১টার পর মোহাম্মদপুরের কোনো এলাকায় দোকান খোলা রাখে, তাহলে তার বিনিময়ে তাদের টাকা দিতে হয়। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে তিন রাস্তার মোড় এলাকার ফুটপাতের টাকা উঠায় রিংকু এবং আল্লাহ করিম মসজিদ মার্কেটের সামনের ফলের দোকানদার আল আমিন। এরপর সেই টাকা মোল্লা রুবেলের হাত হয়ে একটি রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের হাত ঘুরে চলে যায় ওসির পকেটে। যে কারণে ডিএমপি কমিশনারের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও সড়কের দুই-তৃতীয়াংশ দখল করে দোকান বসানো হয়। এর ফলে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড ও তিন রাস্তার মোড় এলাকায় সার্বক্ষণিক তীব্র যানযট লেগেই থাকে।

আরও পড়ুনঃ  হাসিনা-কাদেরসহ ১৫৫ জনের নামে মামলা, আসামি বিএনপি নেত্রীও

জানা গেছে, জেনেভা ক্যাম্পের মাদক কারবারিদের প্রধান বুনিয়া সোহেল ও চুয়া সেলিম। এই সিন্ডিকেট জেনেভা ক্যাম্পে সিরিয়াল দিয়ে দাঁড় করিয়ে মাদক বিক্রি করে। এ রকম বেশকিছু ভিডিও রয়েছে কালবেলার হাতে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ওসি সিন্ডিকেট জিয়া ও শান্তসহ আরও অনেকের মাধ্যমে মাদকের টাকা নিয়ে বুনিয়া সোহেলকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। কয়েকদিন আগেও তার কাছ থেকে প্রায় পৌনে তিন কোটি টাকা উদ্ধার করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই সিন্ডিকেট যাকে খুশি যে কোনো মামলায় ঢুকিয়ে দেয়, আবার যাকে খুশি টাকার বিনিময়ে গভীর রাতে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেয়।

স্থানীয়দের আরও অভিযোগ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ের একাধিক হত্যা মামলার আসামি এবং খাল দখল করে গড়ে তোলা সিলিকন সিটির এমডি সারোয়ার খালিদকে গ্রেপ্তারের পর প্রায় ৫০ লাখ টাকা নিয়ে একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। পাশাপাশি বছিলা গার্ডেন সিটির শামীম কোম্পানি থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকা নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার না করে বছিলা ব্রিজ পার করে দিয়ে আসে পুলিশ।

অভিযোগ রয়েছে, জেনেভা ক্যাম্পের শীর্ষ মাদক কারবারি বুনিয়া সোহেল ও চুয়া সেলিমকে গ্রেপ্তারের পর তাদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন ওসি। এ ছাড়া সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে এনে তার পরিবারের কাছ থেকে ৩০ লাখ টাকা নেওয়ার বিষয়টি কালবেলাকে জানিয়েছে খোদ থানা পুলিশেরই একটি সূত্র। একটি অভিযানে গিয়ে মবের শিকার হন মোহাম্মদপুর থানার সাবেক এসআই মাসুম। এরপর তাকে মোম্মদপুর থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সূত্র জানিয়েছে, পুরো ঘটনাটি ছিল ওসির পরিকল্পিত। কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান চালিয়ে এসআই মাসুম বাটালি গ্রুপ নামে একটি সন্ত্রাসী দলের বিরাগভাজন হন। এরপর ওই সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে এসআই মাসুমসহ তার ফোর্সকে মবের মুখে ফেলে সরিয়ে দেন ওসি। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট এলাকা থেকে সাবেক কাউন্সিলর সলুর আত্মীয় ও মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মন্টুকে আটক করে ১৬ লাখ টাকা নিয়ে তাকে একটি সাধারণ মারামারির মামলায় কোর্টে চালানের অভিযোগ ওসির বিরুদ্ধে। ওসির টাকা নেওয়ার বিষয়গুলো স্থানীয়দের কাছে ‘ওপেন সিক্রেট’। এখন পর্যন্ত স্থানীয়রা পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও ডিএমপি কমিশনার বরাবর কয়েক ডজন লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি আলী ইফতেখার হাসান গত রোববার মোহাম্মদপুর থানায় বসে বলেন, ‘আমি একজন ওসির সঙ্গে কথা বলেছি, যিনি এখানে দেড় বছর ছিলেন। তিনি বলেছেন, দেড় বছরে তার বিরুদ্ধে ১৫০টি তদন্ত হয়েছে। পরে আমি তাকে বললাম স্যার, তাহলে তো আমি অনেক ভালো আছি। আমার বিরুদ্ধে ৬ মাসে মাত্র ৩০টি তদন্ত হচ্ছে। এই জায়গাটাই খারাপ। এটা ওসির সমস্যা নয়, এখানে এসে কোনো ওসি বেশিদিন থাকতে পারেন না।’

আর ওসি আলী ইফতেখার হাসানের বিরুদ্ধে ওঠা বিস্তর অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. ইবনে মিজান বলেন, ‘উনার (ওসি ইফতেখার) বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ, তা নিয়ে বিস্তর তদন্ত হচ্ছে। তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষে দোষ প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে পরিদর্শক তদন্তকে কেন ক্লোজ করা হয়েছে, সেটি আমার জানা নেই।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘উনার (ওসি ইফতেখার) বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগের কথা বললেন, সেগুলো তদন্তাধীন। আর পরিদর্শককে (তদন্ত) কেন বদলি করা হয়েছে, সেটি আমি জানি না।’

আপনার মতামত লিখুনঃ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ