গত ৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ১৫০ জনের অধিক নেতাকে বিভিন্ন কমিটির মাধ্যমে পুনর্বাসন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিরুদ্ধে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে গণমাধ্যমে উঠে না আসলেও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের ৪৫৫ জন সদস্যের কমিটি অন্তত অর্ধশতাধিক ছাত্রলীগ নেতাকে পুনর্বাসন করার তথ্য পেয়েছে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস। এমনকি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হওয়া সত্ত্বেও দুই বহিরাগত শিক্ষার্থী ছাত্রদলের ওই কমিটিতে পদ পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন নেতাকর্মীরা।
ছাত্রদলের ঘোষিত এসব কমিটিতে ছাত্রলীগের সাবেক পদধারী নেতাকর্মী, এমনকি সমর্থক পর্যায়ের অনেককেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব কমিটির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট এলাকার তৃণমূল নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বিতর্কিত এ পুনর্বাসনের ঘটনায় দলের ভেতর-বাইরে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে কয়েকজন নেতাকে কমিটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে। তবে কমিটিতে নাম না থাকলেও, ছাত্রদলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের প্রশ্রয়ে অনেকেই অঘোষিতভাবে সংগঠনের অভ্যন্তরে সক্রিয় রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
‘‘ছাত্রদল কোনোভাবেই ছাত্রলীগকে পুনর্বাসন করছে না। আমাদের সংগঠনের কাঠামোতে যদি কেউ ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী হয়ে প্রবেশ করে থাকে, আমরা সেসব বিষয় গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখি এবং প্রয়োজনে তাদের বাদ দিয়ে দিই। যাদের সম্পৃক্ততা ছিল, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার চেষ্টাও করা হয়েছে-নাছির উদ্দীন নাছির, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক
এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়াকে ঘিরে ছাত্রদলের ভবিষ্যৎ সাংগঠনিক অবস্থান, আদর্শিক দৃঢ়তা এবং নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলে ছাত্রলীগের সাইফুল ইসলাম, মাহাদী ইসলাম, সৈয়দা সুকাইনা নাফিসা, ইমরান হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন, রায়হান হোসেন, মো. বজলুর রহমান বিজয়, শরীফ উদ্দিন সরকার, সাইফ উল্লাহ ও কাজী শাকিব মিয়াকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ছাত্রদল থেকে তাদের মধ্যে ৬ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ২৪২ সদস্যের ওই পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে জায়গা পাওয়া অনেককেই কখনো আন্দোলন-সংগ্রামে দেখা যায়নি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৭৭ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটিতে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট ১৩ জনকে ছাত্রদলে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তারা হলেন— রিফাত আকন্দ অন্তর, রবিন রহমান, মোস্তাফিজুর রহমান, হারুনুর রশিদ, সাদিকুল ইসলাম শুভ, রায়হান পারভেজ, জোবায়ের হাসান রিফাত, গোলাম রব্বানী অর্ণব, রিহাব হোসেন, খন্দকার সাকিব আঞ্জুম শারফি, এস এম শাহরিয়ার হামজা শ্রেষ্ঠ, তাসলীম খান বাপ্পী এবং নাসির উদ্দীন মিয়া। তাদের মধ্যে ৬ জনকে পরবর্তীতে বহিষ্কার করা হয়েছে— যোবায়ের আল মাহমুদ, নাইমুর রহমান কৌশিক, আবদুল গাফফার, আল ইমরান, আবদুল কাদের মারজুক এবং ইকবাল হোসেন।
‘‘এটা শুধু কোনো একটি দল নয়, অনেক রাজনৈতিক দলেই এমনটা দেখা যাচ্ছে। নতুন যে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে, তাদের মূল সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন এমনকি ছাত্রশিবিরের মধ্যেও ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের পুনর্বাসনের খবর আমরা দেখেছি-মো. রাশেদ খাঁন, গণ অধিকার পরিষদের নেতা
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের ৫৪ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে ১৫ জনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তারা হলেন— দুর্জয় শুভ, মাহমুদুল হাসান রাকিব, শাহরিয়ার গালিব, মো. ফারুক খন্দকার, শফিকুল ইসলাম, শাহজাহান, জহিরুল ইসলাম জহির, শেখ মেহেদী হাসান সাকিব, আনোয়ার হোসেন, মো. সাইফুল্লাহ, মো. তৌফিক রহমান আকাশ, মো. সাব্বির আহম্মেদ শুভ, কৌশিক মো. রাজেল প্রামাণিক, সজীব ঘোষ, অপি সরকার, নাহিদুর রহমান সাকিব এবং মো. জুয়েল হোসেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের ৭৬ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে ১০ জন ছাত্রলীগ নেতাকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তারা হলেন— মো. মোবিন সিদ্দিক, নুর আলম রাজিব, খালিদ সাইফুল্লাহ, মো. জুনায়েদ হাসান, মো. শরীফ মিয়া, তারেক রহমান, আছিফ মাহবুব ওহী, খলিলুর রহমান চাঁদ, মোহাম্মদ সোহানুর রহমান এবং মুনতাসির মামুন শুভ।
পাবনা মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের ২২ সদস্যের কমিটিতে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্ট ১১ জনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। তারা হলেন— হাসিবুল হাসান শুভ, আমিমুল আহসান তনিম, রাহুল রায়, শেখ আল ফায়াদ, ইয়াসির আরাফাত, তরিকুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, তাসরীফ আলম, স্বাধীন মিয়া, নাছির উদ্দীন নাবিল ও সামিন রাফিদ।
এছাড়াও বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এবং জেলা কমিটির বিভিন্ন ইউনিটে ছাত্রলীগ নেতাদের পুনর্বাসনের তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অনেকেই যে পদে ছাত্রলীগে ছিলেন, একই পদে ছাত্রদলে পুনর্বাসিত হয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে নিজের প্রভাব বিস্তার এবং দল ভারী করতেই ছাত্রলীগের নেতাদের দলে ভেড়ানো হয়েছে। বিশেষত ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের এক নেতার তথ্য চিত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ থেকে ছাত্রদলে পুনর্বাসিত হয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে এক নেতার বিরুদ্ধে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রহিম, রাসেল আহমেদ (ছাত্রলীগ কর্মী), আব্দুর রাজ্জাক (ছাত্রলীগ কর্মী) এবং মারুফ হাসান হৃদয় সরকারসহ আরও অনেকেই ছাত্রদলে পুনর্বাসিত হয়েছেন।
এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পদবঞ্চিত ছাত্রদল নেতাদের অভিযোগপত্রে একাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে পুনর্বাসনের তথ্য উঠে এসেছে। যেমন— বগুড়ায় ছাত্রদলের তিনটি ইউনিট কমিটিতে ২৩ জনকে পুনর্বাসনের দাবি করেছিল পদবঞ্চিতরা।
এদিকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিতে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পুনর্বাসনের খবর পাওয়া গেলেও সেসব কমিটি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা হয়নি। তবে এসব নেতাদের ছাত্রদলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে।
পুনর্বাসনের বিষয়ে জানতে চাইলে গণ অধিকার পরিষদের নেতা মো. রাশেদ খাঁন বলেন, এটা শুধু কোনো একটি দল নয়, অনেক রাজনৈতিক দলেই এমনটা দেখা যাচ্ছে। নতুন যে রাজনৈতিক দল গঠিত হয়েছে, তাদের মূল সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন এমনকি ছাত্রশিবিরের মধ্যেও ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের পুনর্বাসনের খবর আমরা দেখেছি।
তিনি বলেন, ‘আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি করতাম, তখন ক্যাম্পাসে দমন-পীড়নের একমাত্র ছাত্রলীগ করতো। আমি ভর্তি হওয়ার পর থেকে শুরু করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের আগ পর্যন্ত ছাত্রলীগের মিছিল-মিটিংয়ে আমাদের জোর করে নিয়ে যেত। সেই সময়ের অনেক ছবি ও ভিডিও হয়ত অনেকে সংরক্ষণে রেখেছে। এখন কেউ যদি সেই সূত্র ধরে বলে আমি ছাত্রলীগ করতাম, সেটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?’
রাশেদ খান আরও বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা ভর্তি হয়, অনেক সময় তাদের বাধ্য হয়েই মিছিলে অংশ নিতে হয়। ছাত্রলীগের পদ-পদবি পাওয়া আর আদর্শগতভাবে ছাত্রলীগ করা এক বিষয় নয়। যারা অন্যায় বা অপরাধ করেছে, তাদের আমরা চিনি এবং সেসব অপরাধের বিরুদ্ধে আমি সবসময়ই সোচ্চার থেকেছি। কিন্তু শুধু ছাত্রলীগের কোনো পদে ছিল বলে, কেউ যদি অন্যায় বা অপরাধ না করেও হয়রানির শিকার হয়, সেটাও যেন না ঘটে—এই দিকটিও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।’
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন বলেন, ছাত্রদল কোনোভাবেই ছাত্রলীগকে পুনর্বাসন করছে না। আমাদের সংগঠনের কাঠামোতে যদি কেউ ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী হয়ে প্রবেশ করে থাকে, আমরা সেসব বিষয় গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখি এবং প্রয়োজনে তাদের বাদ দিয়ে দিই। যাদের সম্পৃক্ততা ছিল, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার চেষ্টাও করা হয়েছে।
ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ (ফাইল ছবি)
আপনি যে পরিসংখ্যানের কথা বলছেন, সেটি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আমাদের নীতিমালায় ছাত্রলীগকে পুনর্বাসনের কোনো জায়গা নেই। ছাত্রলীগ ঘেঁষা কারও ব্যাপারে কোনো পুনর্বাসনের উদ্যোগ আমাদের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। বরং অন্যান্য দল—যেমন শিবির কিংবা বাংলা কলেজের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেই এ ধরনের পুনর্বাসনের নজির দেখা গেছে।
হ্যাঁ, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা আমাদের দলে ঘটেছে, তবে আমরা সেসব বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০ জন ছাত্রলীগ নেতার পুনর্বাসনের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন— আমার জানা মতে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলে ছাত্রলীগের কোনো সাবেক নেতার জায়গা হয়নি। কেউ কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব তথ্য ছড়িয়ে ছাত্রদলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা করছে। তবে কেউ যদি নির্ভরযোগ্য ও সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারে, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।
ছাত্রদলে ছাত্রলীগের পুনর্বাসন হয় কীভাবে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, কেউ হয়ত পাঁচ বছর আগে হলে উঠেছে, কোনো মিছিলে বা সামাজিক কারণে ছাত্রলীগের সঙ্গে ছবি তুলেছে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। পরে সে ছাত্রদলে সক্রিয় হয়েছে। এমন দু-একটি ব্যতিক্রম উদাহরণ আমরা দেখেছি। তবে এমন ঘটনা আমরা দেখিনি যে, কেউ ৫ তারিখ পর্যন্ত ছাত্রলীগ করেছে আর পরে এসে এসে ছাত্রদল করছে। যেসব সন্দেহজনক ঘটনা আমরা পেয়েছি, সেগুলোর ক্ষেত্রে সংগঠন সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নিয়েছে।’