৪০ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে রপ্তানি খাতে এমন সংকট কখনো দেখেননি বলে মন্তব্য করেছেন দেশের অন্যতম রপ্তানিকারক, ব্যবসায়ী নেতা ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ. কে. আজাদ। তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা এ খাতকে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে এসেছি; কিন্তু এখন হতাশ ও ক্ষুব্ধ। গতকাল রোববার যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: কোন পথে বাংলাদেশ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এ. কে. আজাদ এসব কথা বলেন। দৈনিক প্রথম আলো রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে এ গোলটেবিলের আয়োজন করে। এতে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও গবেষকরা তাদের মতামত তুলে ধরেন।
এ. কে. আজাদ বলেন, আমার এক বড় ব্র্যান্ড হেড অফিসে ডেকে জানায়, তারা নিজ দেশের সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করেছে। তাদের ভাষ্য ছিল—তোমাদের অবস্থান দুর্বল, ভালো ফল আশা করা যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে এ. কে. আজাদ ক্রেতাদের অবস্থান তুলে ধরেন। বলেন, আমার এক ক্রেতা ইমেইলে জানান, ১ তারিখ থেকে বাংলাদেশের ওপর যে শুল্ক বসবে, তা সরানো না গেলে শুল্কের ৩৫ শতাংশ আমাকে বহন করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, আমি সেই শুল্ক কীভাবে বহন করব। বক্তব্যে ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ইন্দোনেশিয়ায় এক যৌথ উদ্যোগ আছে।
সেখানে সরকার ও ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে কাজ করছেন। লবিস্ট নিয়োগ করেছেন, প্রতিটি স্তরে আলোচনা করেছেন। অথচ বাংলাদেশে আমরা এমন সুযোগ পাইনি। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ প্রসঙ্গে এ. কে. আজাদ বলেন, আপনারা বলছেন, সাত-আট মাসের জন্য দায়িত্বে আছেন। এরপর চলে যাবেন। তখন আমরা যাব কোথায়? আমাদের কার কাছে ফেলে রাখছেন। সবার ধারণা, আমাদের মাথার ওপর একজন আছেন। তিনি একটা ফুঁ দিয়ে দেবেন আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যার জন্য আমাদের কোনোরকম মূল্যায়ন করা হচ্ছে না; কোনো লবিস্ট নিয়োগের চিন্তা করা হচ্ছে না।
অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে ধরনের নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) সই করেছে, তা দেশের ইতিহাসে এই প্রথম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো পার্টনার (অন্য দেশ) কোনোদিন এনডিএ ডকুমেন্ট দেয়নি। এর বদলে নন-পেপার ইস্যু করা যেত। যার অর্থ হলো এটা আমার অবস্থান, কিন্তু আমি নিজে সই করব না। নন-পেপার হলে রেসপনসিবিলিটি তৈরি হতো; কিন্তু এখন বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়ে গেছে। এখন যদি বাংলাদেশ কোনো লবিস্ট নিয়োগ করে, তার কাছেও এ তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, এমন নির্দোষ আর নিষ্পাপ সরকার আমি আগে দেখিনি। কোনো দুর্বল এবং অসমন্বিত সরকারের যদি রাজনৈতিক বৈধতা না থাকে, তাহলে তাদের সফলভাবে দরকষাকষি করার নজির বিরল। তবে দেবপ্রিয় এও মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এ নতুন শুল্কনীতি দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর হবে না। তা সত্ত্বেও এ উদ্যোগকে তিনি বাংলাদেশের জন্য একটি ওয়েক আপ কল হিসেবে দেখছেন। এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, বাংলাদেশ আগামী দিনে কোথায় যাবে, তা নির্ধারণে এই নতুন শুল্ক ব্যবস্থা আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। বিশেষ করে পণ্য বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, বাংলাদেশি পণ্যে বাড়তি শুল্ক কমানোর দরকষাকষির জন্য লবিস্ট নিয়োগ করার চেষ্টা করা হচ্ছে গতকাল থেকে, আমরা লবিস্ট নিয়োগে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছি। তবে লবিস্টদের কাছ থেকে সাড়া কম পাচ্ছি। তার কারণ, বেশিরভাগই বিভিন্ন দেশের পক্ষে যুক্ত হয়ে গেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে তিন দিন আগেও আশাবাদী ছিলাম। যারা সরাসরি দরকষাকষি করছেন, তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন, তারা খুবই আত্মবিশ্বাসী। তবে দুদিন আগে থেকে কানাঘুষা চলছে যে, তারা বুঝতে পেরেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) পাল্টা শুল্ক কমানোর চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ নয়। ট্রাম্প প্রশাসন হচ্ছে সেই কর্তৃপক্ষ। এটা বুঝতে এত সময় লাগল!
বিজিএমইএর সভাপতি বলেন, ‘আমরা যদি বিষয়টি এক মাস আগে জানতে পারতাম, তাহলে লবিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়াটি শুরু করতে পারতাম। আমার সংগঠনের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা এ মুহূর্তে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে নিরুৎসাহিত করছেন। তার কারণ, এটা (দরকষাকষি) ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। আমরা কেন ব্যর্থতার দায়ভার নেব? তৈরি পোশাক রপ্তানি আমাদের রুটিরুজি। দেরি হয়ে গেলেও আমরা লবিস্ট নিয়োগ করার চেষ্টা করছি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিআরআইয়ের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি। দুর্ভাগ্যবশত, সরকার কখনো বেসরকারি খাতকে স্বীকৃতি দেয়নি।