রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত শিক্ষিকা মাসুকা বেগম নিপুর মরদেহ তার বোনের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুর গ্রামে নিয়ে আসা হলে শোকের ছায়া নেমে আসে এলাকায়। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বাদ আসর সোহাগপুর ঈদগাহ মাঠে জানাজা শেষে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। জানাজায় এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সর্বসাধারণ অংশ নেন।
মা সমিরন বেগম মারা গেছেন প্রায় ১৫ বছর আগে। পরিবারের একমাত্র ভাই থাকেন প্রবাসে। বাবা অসুস্থ। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তবে নিজে বিয়ে করেননি। শিক্ষক মাসুকার সংসার বলতে ছিল শিক্ষার্থীরাই।
সংসারের সদস্যদের বাঁচাতে প্রাণপণ লড়ে গেছেন। তবে নিজের জীবনযুদ্ধে হেরে গেছেন মাসুকা বেগম (৪০)।
বিমান দুর্ঘটনায় আহত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মাসুকা সোমবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার সোহাগপুর গ্রামের ঈদগাহ মাঠসংলগ্ন কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়। সোহাগপুরে বড় বোন পাপিয়ার বাড়ি। মৃত্যুর আগে মাসুকা জানিয়েছিলেন লাশটা যেন তার বোনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
বোনের ইচ্ছা অনুযায়ী লাশ দাফনের কথাও তিনি বলে যান।
মাসুকাদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার চিলোকট গ্রামে। তবে বেড়ে উঠেছেন পৌর এলাকার মেড্ডায় থেকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্স করা মাসুকা চাকরি সুবাদে চলে যান ঢাকা। প্রথমে মিরপুরের একটি স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেন।
এরপর যোগ দেন মাইলস্টোন স্কুলে। তবে স্কুলটিতে তিনি ঠিক কত বছর ধরে আছেন, সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মঙ্গলবার দুপুর ২টার পর মাসুকার লাশ সোহাগপুর গ্রামে নিয়ে আসা হয়। লাশবাহী গাড়ির শব্দ শুনে জড়ো হতে থাকে আশপাশের মানুষ। আগে থেকে ভিড় করে রেখেছিলেন অনেকে। সোহাগের বোন জামাই খলিলুর রহমানের বাড়িতে কেমন যেন এক নিস্তব্ধতা।
একটি চেয়ারে নির্বাক বসা ৭০ বছর বয়সী বাবা সিদ্দিক আহমেদ চৌধুরী। অনেক কথার পর এ প্রতিবেদককে এটুকুই বললেন, ‘মেয়েটার সঙ্গে এক সপ্তাহ আগেও মোবাইল ফোনে কথা হলো। আমার জন্য টাকা পাঠাইছে বলল। সবসময় সে আমার জন্য টাকা পাঠায়।’
জানাজায় দাঁড়ানোর আগে বাবাকে একনজর দেখানো হলো লাশবাহী গাড়িতে থাকা মাসুকাকে। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না বাকরুদ্ধ সিদ্দিক আহমেদ। চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন, ‘হায় আল্লাহ।’ মেয়ের জন্য দোয়া করতে বলে তাকে সরিয়ে আনা হয়।
গ্রামের মানুষ বলাবলি করছিল মাসুকার বীরত্বগাথা নিয়ে। কেউ স্বজনদের কাছ থেকে শুনেছেন। কেউ সামাজিক যোাগযোগ মাধ্যমে দেখেছেন। মাসুকা নিজে দগ্ধ হয়েও শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচিয়েছেন। মৃত্যুর আগেও শিক্ষার্থীর অবস্থার কথা চিন্তা করেছেন। জনবহুল এলাকায় এভাবে বিমান প্রশিক্ষণ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন ছিল সবার মুখে মুখে। এ বিষয়ে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেবে বলেও এলাকার মানুষ আশা প্রকাশ করে।
মাসুকার ভাগ্নি ফাহমিদা নিধি এসব বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দিনভর খালাম্মার খোঁজ পাইনি। রাতে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে যখন খবর পাই এর কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুর খবর আসে। তবে নানাসহ অন্যদের অনেক পরে খালাম্মার মৃত্যুর খবর শোনানো হয়। আমরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না মৃত্যুর খবরটি।’
আহসান হাবিব পারভেজ নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘মাসুকা সম্পর্কে আমার শ্যালিকা হয়। আমরা যতটুকু জেনেছি সে অনেক শিক্ষার্থীর জীবন বাঁচিয়েছে। নিজে অসুস্থ হয়েও শিশু শিক্ষার্থীদের কথা সে চিন্তা করেছে। এক চিকিৎসক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমরা মাসুকার মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত হই। মাসুকার মৃত্যুর আগে বলে গেছে তার আপন বোন পাপিয়ার কাছে যেন লাশ পৌঁছে দেওয়া হয়। বোনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ি যেন তাকে দাফন করা হয়। সে নিজেও বুঝতে পারছিলো যে তার মৃত্যু হবে।’
পাপিয়া আক্তারের স্বামী মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘মাসুকারা তিন ভাই-বোন। ভাই প্রবাসে থাকে। মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনার পর আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে খবর নিতে থাকি। রাতে খবর পাই মাসুকা চিকিৎসাধীন আছে। তবে অবস্থা বেশি ভালো না। এরই মধ্যে গভীর রাতে তার মৃত্যুর খবর আসে। মাসুকার ইচ্ছা অনুযায়ি সোহাগপুর গ্রামে তাকে দাফন করা হয়।’
আশুগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি মো. শাহজাহান সিরাজী বলেন, ‘এমন দুর্ঘটনায় মৃত্যু কারো কাম্য নয়। তবে মাসুকা তাঁর শিক্ষার্থীদের বাঁচানোর যে বীরত্ব দেখিয়ে গেছে এতে আমরা গর্বিত। তাঁর স্মৃতিকে যেন সরকার ধরে রাখে সে দাবি জানাই।’
কথা হয় মাসুকার শিক্ষক সরকারি জিল্লুর রহমান কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবু হানিফার সঙ্গে। কথা বলতে গিয়ে বারবার তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘মাসুকার ডাকনাম ছিলো নিপু। তাকে আমি নিপু বলেই ডাকতাম। সে ছিলো আমার প্রিয় ছাত্রী। শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেওয়ার পরও সে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো।