রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্তের কারণ জানা যায়নি। বিমান বাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই মডেলের বিমানটি ঢাকার কুর্মিটোলার এ কে খন্দকার ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরই বিধ্বস্ত হয়।
রহস্য উদঘাটনে গতকাল মঙ্গলবারও সন্ধান করা হয় বিমানের ব্ল্যাক বক্সের, কিন্তু তা মেলেনি। সেটি পাওয়া গেলে প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তবে অনেকে দাবি করছেন যান্ত্রিক ত্রুটিই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। আবার কেউ কেউ পাইলটের অদক্ষতাকে দুষছেন। এদিকে দুর্ঘটনায় পাইলটসহ ৩১ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ১৬৫ জন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) গতকাল জানায়, বিমান বাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমানটি নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার দুপুর ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলার বিমান বাহিনীর এ কে খন্দকার ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। এ দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা ভবনে বিধ্বস্ত হয়।
বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ক্যাপ্টেন হেলাল আমার দেশকে বলেন, ‘নিহত পাইলটের দক্ষতা নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই। সোলো ফ্লাইটের সেদিন ছিল তার শেষ দিন। এটি হাইড্রোলিক ফেইলিউর বা ইঞ্জিনের ত্রুটিও হতে পারে। বিমান বাহিনী সবসময় পুরোনো উড়োজাহাজ দুর্নীতির মাধ্যমে কিনে থাকে। তারা প্রশিক্ষণের জন্য নতুন আধুনিক উড়োজাহাজ কেনে না। আমাদের আশপাশের কোনো দেশই এখন এসব যুদ্ধবিমান দিয়ে প্রশিক্ষণ দেয় না। তাছাড়া এসব সোলো ট্রেনিং হয় সাধারণত সকালের দিকে। যখন ট্রাফিক কম থাকে। কী কারণে সেদিন পাইলটকে দুপুরে দেওয়া হয়েছিল আমার বোধগম্য নয়।’
জানা গেছে, ব্ল্যাক বক্স কালো কোনো বস্তু নয়, বরং এর রঙ অনেকটা কমলা ধরনের। এটি অত্যন্ত শক্ত ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়। কয়েকটি স্তর দিয়ে এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে প্রচণ্ড উত্তাপ, ভাঙচুর, পানি বা প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও এটি টিকে থাকতে পারে। এটি ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও অক্ষত থাকতে পারে। স্টেইনলেস স্টিল, টাইটেনিয়ামের খোলস দিয়ে বাক্সের আবরণ তৈরি করা হয়। টিকে থাকার অনেক পরীক্ষায় পাস করার পরেই এগুলোকে বিমানে সংযোজন করা হয়।
এটি দুটি অংশের সমন্বয়ে একটি ভয়েস রেকর্ডার মাত্র। বিমান চলাচলের সময় সব ধরনের তথ্য এটি সংরক্ষণ করে রাখে। এর মধ্যে দুই ধরনের তথ্য সংরক্ষিত থাকে। একটি হলো, ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার (এফডিআর)। অপরটি হলো ককপিট ভয়েস রেকর্ডার (সিভিআর)।
এফডিআরের কাজ কী
এটি বিমানের ওড়া, ওঠানামা, বিমানের ভেতরের তাপমাত্রা, পরিবেশ, চাপ বা তাপের পরিবর্তন, সময়, শব্দ ইত্যাদি নানা বিষয় নিজের সিস্টেমের মধ্যে রেকর্ড করে রাখে।
সিভিআরের কাজ কী
এটিতে ককপিটের ভেতর পাইলটদের কথাবার্তা, পাইলটদের সঙ্গে বিমানের অন্য ক্রুদের কথা, ককপিটের সঙ্গে এয়ার কন্ট্রোল ট্রাফিক বা বিভিন্ন বিমানবন্দরের সঙ্গে রেডিও যোগাযোগের কথা রেকর্ড হয়ে থাকে।
বিমান চলাচলের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্ল্যাক বক্স তথ্য সংরক্ষণ করে রাখে। মূলত শেষের দিকের তথ্য এটিতে জমা থাকে। একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর আগের তথ্য মুছে যেতে থাকে আর নতুন তথ্য জমা হয়। ফলে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সর্বশেষ তথ্য এটিতে পাওয়া যায়।
সামরিক সরঞ্জাম-সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট গ্লোবাল সিকিউরিটিডটকমের তথ্য অনুযায়ী, এফটি-৭ বিজিআই মডেলের বিমানের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন। এটি স্বল্প খরচে নির্মিত, এক ইঞ্জিনচালিত ও দুই আসনবিশিষ্ট একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান। মূল সংস্করণ এফ-৭ এর জন্য পাইলটদের প্রস্তুত করতে এফটি-৭ বিজিআইর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এফটি-৭ বিজিআই সংস্করণটি বিমান বাহিনীতে ২০১৩ সালে চীন থেকে এসে যুক্ত হয়েছে।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক আকাশ প্রতিরক্ষাবিষয়ক ওয়েবসাইট এয়ারফোর্স টেকনোলজির তথ্য অনুযায়ী, ইরান, ইরাক, আলবেনিয়া, নাইজেরিয়া, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও মিসরে এ যুদ্ধবিমান রয়েছে। তবে ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এ যুদ্ধবিমানের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
বিমান বাহিনীপ্রধানের বক্তব্য
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো গুজবে কান না দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন বিমান বাহিনীপ্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন। তিনি বলেন, ‘তথ্য লুকানোর বা গোপন করার কিছুই নেই। কার কাছে গোপন করব। দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই।’
গতকাল দুর্ঘটনায় নিহত পাইলটের জানাজার পর সংবাদকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা তদন্ত করে বের করবে কী ঘটেছিল। তার ভিত্তিতে কোনো ভুলত্রুটি থাকলে সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব।’
বিমান বাহিনীপ্রধান বলেন, ‘পাইলট সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন বিমানটিকে একটি খালি জায়গায় নামানোর এবং তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেছেন। তবে প্রযুক্তি পুরোনো হলেও এই বিমানগুলো পুরোনো নয়।’
দেশে এর আগে একাধিকবার প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে তামান্না রহমান নামের এক পাইলট নিহত হন।
২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর কক্সবাজারে প্রশিক্ষণের সময় বিমান বাহিনীর দুটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এ ঘটনায় রাশিয়ায় নির্মিত ইয়াক-১৩০ মডেলের দুটি বিমান বিধ্বস্ত হলেও চার জন বৈমানিক নিরাপদে বের হয়ে আসতে সক্ষম হন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলে একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। এতে পাইলট উইং কমান্ডার আরিফ আহমেদ নিহত হন।