Saturday, August 9, 2025

লুট হওয়া অস্ত্রের গুলিতে মৃত্যু, ‘শহীদ’ বানিয়ে ‘জুলাই বাণিজ্য’

আরও পড়ুন

জুলাই অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের দিনে নোয়াখালীর চাটখিলে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন উপজেলার হাটপুকুরিয়া ঘাটলাবাগ ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামের ইমতিয়াজ হোসেন (২২)। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

পরে বাবার করা আবেদনের পরিপ্রক্ষিতে ইতোমধ্যে জুলাই শহীদ হিসেবে গেজেটভুক্তও হয়েছে ইমতিয়াজ আহমেদের নাম। তবে অভ্যুত্থানের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলেও ইমতিয়াজের মৃত্যু ঘিরে উঠেছে প্রশ্ন।

স্থানীয় লোকজন এবং শিক্ষার্থীরা বলছেন, জুলাই আন্দোলনে ইমতিয়াজের কোনো ধরনের অংশগ্রহণ ছিল না এবং তার মৃত্যু হয়েছে থানা থেকে লুট করা অস্ত্র থেকে দুর্ঘটনাবশত বের হওয়া বুলেটের আঘাতে। তবে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ছেলেকে ‘শহীদ’ বানিয়ে তার বাবা মো. হাবিবুর রহমান সরকারি সুযোগ-সুবিধা আদায় এবং মামলা-বাণিজ্য চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্থানীয়রা জানান, জুলাই অভ্যুত্থানে ইমতিয়াজের সক্রিয় অংশগ্রহণের কোনো প্রমাণ নেই। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর চাটখিল পৌরবাজারে যে আনন্দ মিছিল হয়, ইমতিয়াজ তাতে অংশ নিয়েছিলেন। সেদিন বিকেলে চাটখিল থানায় হামলা ও অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটে। থানার অস্ত্র লুটের কিছু সময় পর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ইমতিয়াজকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়।

সেখানে তিনি প্রত্যক্ষদর্শীদের বলেছিলেন, বন্ধুদের কেউ একজন তাকে গুলি করেছে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, থানা থেকে লুট করা অস্ত্র নিয়ে পালানোর সময় দুর্ঘটনাবশত নিজের সঙ্গে থাকা অস্ত্রের বুলেটে ইমতিয়াজ বিদ্ধ হয়েছিলেন। পরদিন ৬ আগস্ট ভোরে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুনঃ  আলোচিত সেই কিডনিকাণ্ডে নতুন মোড়

ছেলের মৃত্যুর প্রায় দুই মাস পর ২০২৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর হাবিবুর রহমান ছেলেকে ‘জুলাই শহীদ’ হিসেবে স্বীকৃতির জন্য প্রশাসনের কাছে আবেদন করেন। এরপর ২০২৫ সালের ২১ মে ৫৭ জনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, মামলা থেকে নাম কাটার বিনিময়ে তিনি অর্ধকোটি টাকারও বেশি ‘মামলা বাণিজ্য’ করেছেন।

এ বিষয়ে বুধবার (৬ আগস্ট) জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন জমা দেন উপজেলার ছাত্র প্রতিনিধিরা। এর আগে গত ২৭ মার্চ চাটখিল উপজেলার শিক্ষার্থীরা ইমতিয়াজের নামে থাকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট বাতিল করার দাবি জানান।

শিক্ষার্থীদের দাবি, ইমতিয়াজ হোসেন একটি কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারি ম্যান ছিলেন। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের খবর ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে চাটখিল থানায় ঢুকে অস্ত্র লুট করেন। লুট করা অস্ত্র কোমরে রেখে পালানোর সময় দুর্ঘটনাবশত নিজের কাছে থাকা অস্ত্রের গুলিতে বিদ্ধ হন তিনি। ইমতিয়াজের আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ, ছবি বা ভিডিও এখন পর্যন্ত কোথাও পাওয়া যায়নি। এমনকি আন্দোলনের সময় তার উপস্থিতি সম্পর্কেও কোনো তথ্য নেই।

আরও পড়ুনঃ  ৩০ লাখ টাকা লোন পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাসে ধর্ষণ, অতঃপর...

জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া শিক্ষার্থীদের আবেদনে বলা হয়েছে, ইমতিয়াজের বাবা হাবিবুর রহমান কোনো সরকারি বা বেসরকারি উৎস যেমন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন কিংবা অন্য কোনো তহবিল থেকে যদি কোনোভাবে অর্থ গ্রহণ করে থাকেন এবং যদি সেই অর্থ অপব্যবহার বা আত্মসাতের প্রমাণ মেলে, তবে তার বিরুদ্ধে যেন কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

আবেদনে স্বাক্ষরকারী নোয়াখালী সরকারি কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম রনি বলেন, ‘ইমতিয়াজের মৃত্যুকে শহীদ বানিয়ে তার বাবা হাবিবুর রহমান গেজেটভুক্তির মাধ্যমে সরকারি সুযোগ-সুবিধা আদায় করেছেন। মামলার ভয় দেখিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়সহ ৭০-৮০ লাখ টাকা ও জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আরও ১৮ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। তার বাবার ‘জুলাই বাণিজ্য’ নিয়ে আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করলে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে ১০ লাখ টাকার চাঁদাবাজির মিথ্যা অভিযোগ তোলা হয়। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং প্রয়োজনে আইনি পদক্ষেপ নেব।’

নোয়াখালী সরকারি কলেজের আরেক শিক্ষার্থী গোলাপ হোসেন ফরহাদ বলেন, ‘যেভাবে কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই ইমতিয়াজ আন্দোলনে অংশ না নিয়েও ‘জুলাই শহীদ’ হিসেবে গেজেটভুক্ত হয়েছেন। এটি শহীদদের অপমান এবং রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার। আমরা এর কঠোর তদন্ত ও শাস্তি দাবি করছি।’

আরও পড়ুনঃ  প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় ধরা বিএনপি নেতা

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চাটখিল উপজেলা বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘ইমতিয়াজের বাবা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তিনি দলীয় প্রভাব খাটিয়ে নিজের ছেলেকে শহীদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। মানুষকে মামলার ভয় দেখাচ্ছেন। তার ছেলে যখন মারা যায়, তার আগেই আওয়ামী লীগের উপজেলার নেতারা পালিয়েছিলেন। অথচ তিনি তার ছেলে আওয়ামী লীগের হাতে খুন হয়েছে বলে দাবি করছেন।’

ইমতিয়াজের বাবা মো. হাবিবুর রহমান তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমার ছেলের পেটে গুলি লেগেছে। থানার অস্ত্র লুট করেছে মানলাম! কিন্তু সে অস্ত্র যদি তার কোমরে থাকে তাহলে পায়ে বা মাথায় গুলি লাগার কথা, পেটের ভেতরে গুলি লাগার কথা নয়। আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। আমি আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই।’

নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘ইমতিয়াজের বিষয়টি বর্তমানে তদন্তাধীন। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে সব ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে আপাতত বাদ রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সব কর্মসূচি থেকেও তার পরিবারকে বিরত রাখা হয়েছে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর গ্রহণ করা হবে।’

আপনার মতামত লিখুনঃ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ