যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে ভারতীয় পণ্য রপ্তানির ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা ৩০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলারের ভারতীয় রপ্তানি ঝুঁকির মুখে ফেলেছে, বলে জানিয়েছেন সুইস বহুজাতিক ব্যাংক এবং আর্থিক সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান-ইউবিএস’এর প্রধান ভারতীয় অর্থনীতিবিদ টানভী গুপ্তা জেইন।
তিনি আরও বলেন, ভারতের ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি ছিল ৮৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৪৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার ছিল উদ্বৃত্ত। তবে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ফলে ভারতীয় অর্থনীতি এক বা দুই বছরে তার জিডিপি বাড়ার ক্ষেত্রে প্রায় এক শতাংশ হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
রোববার (১০ আগস্ট) সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে, রাশিয়া থেকে ভারতের তেল ক্রয়ের সম্ভাবনা কমানোর বিষয় এবং রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার সর্বশেষ অর্থনৈতিক নীতির আলোকে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির এবং মুদ্রাস্ফীতির বিষয়ে আরও বিশ্লেষণ করেছেন তিনি।
ইতোমধ্যে ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্কের প্রভাব ভারতের তৈরি পোশাক খাতে পড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের পর বিশ্বব্যাপী অনেক বড় ব্র্যান্ড তাদের ভারতে পোশাকের অর্ডার স্থগিত বা অন্য দেশে স্থানান্তরিত করতে শুরু করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া।
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের তামিলনাড়ুর তিরুপ্পুরে নিটওয়্যার রপ্তানিকারকরা মার্কিন শুল্কের কারণে অর্ডার স্থগিত এবং অন্য দেশে সরিয়ে নেওয়ার প্রভাব অনুভব করছেন। অনেক ক্রেতা যারা দীর্ঘদিন ধরে অর্ডার দিয়ে আসছিলেন, তারা এখন অর্ডার স্থগিত বা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় স্থানান্তরিত করছেন, কারণ সেখানে শুল্ক হার ভারতের তুলনায় অনেক কম।
তামিলনাড়ুর এক রপ্তানিকারক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-কে জানিয়েছেন, তার প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত মার্কিন চালান ইতোমধ্যে পাকিস্তানে চলে গেছে। আরেকজন বলেন, তার আমেরিকান ক্রেতা গ্রীষ্মকালীন অর্ডার নিশ্চিত করার আগে তাকে অপেক্ষা করতে বলেছে।
নতুন শুল্ক কাঠামোয়, ভারতীয় পোশাকের ওপর মূল শুল্কের পাশাপাশি অতিরিক্ত জরিমানা আরোপিত হয়েছে, যা কিছু পোশাকের ক্ষেত্রে ৬৪ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এর ফলে, ভারতীয় পোশাকের দাম স্থানীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে রপ্তানিকারকরা সস্তা বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হচ্ছেন এবং মার্কিন শুল্ককে তারা ‘বাণিজ্যিক অবরোধ’ হিসেবে দেখছেন।
তামিলনাড়ুর টেক্সটাইল খাতটি মার্কিন অর্ডারের জন্য যখন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছিল, তখনই নতুন শুল্ক আরোপ করা হলো। তিরুপ্পুর, কোয়েম্বাটুর ও কারু এলাকার কারখানায় ১২ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন এবং এখান থেকে প্রতিবছর ৪৫ হাজার কোটি রুপির পোশাক রপ্তানি হয়।
তামিলনাড়ুর রপ্তানিকারকরা আশাবাদী ছিলেন যে, ভারত-যুক্তরাজ্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি ও চীন ও মিয়ানমারের ওপর উচ্চ শুল্কের কারণে আমেরিকান ক্রেতারা ভারতীয় পোশাকের প্রতি আগ্রহী হবেন, তবে তা এখন শুল্কের ভারে চাপা পড়ছে।
তিরুপ্পুর এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন-এর সভাপতি কে এম সুব্রাহ্মনিয়ান বলেন, ‘এটি বড় ধাক্কা। প্রথমে ছোট রপ্তানিকারক কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক্রেতারা আমাদের শুল্কের অংশ ভাগাভাগি করতে বলছে, কিন্তু আমাদের মুনাফা মাত্র ৫ থেকে ৭ শতাংশ; এই ব্যয় ভাগাভাগি কিভাবে হবে?’
তিনি আরও বলেন, ‘তিরুপ্পুরের রপ্তানির ৩০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে কিছুটা সুরক্ষা পাওয়া যাবে, তবে ক্ষতি ছাড়া তা সম্ভব নয়।’ এছাড়া, ভারতীয় তুলার ওপর ১১ শতাংশ আমদানি শুল্ক এবং পলিয়েস্টার কাঁচামালের ওপর ১৮ শতাংশ শুল্কসহ অন্যান্য শুল্কও রপ্তানি খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এসব সমস্যা প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে।
সেলভারাজু বলেন, ‘এটি শুধু শুল্ক বৃদ্ধির বিষয় নয়, বরং এটি আমাদের দুর্বল পরিবেশকে আরও খারাপ করে তুলেছে।’ তিনি আরও বলেন, ভারতের তুলা আমদানির ওপর ১১ শতাংশ শুল্ক এবং জিএসটি-সংক্রান্ত অসঙ্গতি ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় ক্ষতি সাধন করছে।
তবে, তিনি দাবি করেছেন, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা তুলা মার্কিন মান পূর্ণ করতে পারছে না, এবং যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।
সুব্রাহ্মনিয়ান বলেন, ‘ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ। তাদের ২০ শতাংশ শুল্ক মানে পোশাক অনেক সস্তা। ভারতীয় পোশাকের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ৬৪ শতাংশ, আর এর ফলে সস্তা বিকল্প খুঁজে নেয়া হচ্ছে।’ ভারতের পোশাক খাতের বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, মার্কিন অর্ডার ৪০-৫০ শতাংশ কমে যেতে পারে, যার ফলস্বরূপ তিরুপ্পুর, কোয়েম্বাটুর ও কারু অঞ্চলের এক থেকে দুই লাখ শ্রমিকের চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।
এভাবে, ভারত স্থায়ীভাবে মার্কিন বাজার হারাতে পারে, যেখানে বাংলাদেশের, পাকিস্তানের, ভিয়েতনামের এবং কম্বোডিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো এখন আরও সস্তায় পণ্য রপ্তানি করছে।