Sunday, August 17, 2025

গুলি করার অনুমতি পেয়ে মনোবল বেড়েছে পুলিশের

আরও পড়ুন

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজের পক্ষ থেকে আত্ম রক্ষার্থে তাৎক্ষণিক গুলি চালানোর নির্দেশ পাওয়ার পর মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মনোবল বেড়েছে। তারা বলছেন, এর ফলে ভয়-ভীতি কাটবে এবং সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হতে পারবে না।

১৩ আগস্ট রাতে সিএমপির ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কে দেয়া জরুরি বার্তায় কমিশনার বলেন, পুলিশের সামনে কেউ অস্ত্র বের করা মাত্রই গুলি করতে হবে; সেটা আগ্নেয়াস্ত্র হোক বা ধারালো অস্ত্র। ‘হয় মাথায়, নয়তো বুকে, নয়তো পিঠে, ‘সরকারি’ গুলির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, দণ্ডবিধির ৯৬ থেকে ১০৬ ধারা অনুযায়ী পুলিশ আত্মরক্ষার পূর্ণ অধিকার রাখে। ‘আক্রমণের আগেই, অস্ত্র বের করার মুহূর্তেই গুলি করতে হবে।’

সিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মাহমুদা বেগম আমার দেশকে বলেন, ‘এটি আমাদের ইন্টারনাল একটি নির্দেশনা। এই বিষয়ে আর কিছু বলতে চাই না।’

১১ আগস্ট রাতে বন্দর থানাধীন ঈশান মিস্ত্রি হাট এলাকায় আওয়ামী লীগের মিছিলে ধাওয়া দিতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন এসআই আবু সাঈদ রানা। ধারালো অস্ত্রের কোপে গুরুতর জখম হন তিনি। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

রানার এক সহযোগী বলেন, ‘হঠাৎ করে চার-পাঁচজন রানার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন হাতে দা নিয়ে পেছন দিক থেকে কোপ দেয়। হেলমেট থাকলেও মাথা ফেটে যায়। তখনই ভাবলাম, যদি অস্ত্র ব্যবহার করতাম হয়তো এমন হতো না।’

পুলিশ কর্মকর্তাদের মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের নির্দেশনার পর মাঠ পর্যায়ে থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে স্বস্তি ও আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে।

পাঁচলাইশ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, ‘এই নির্দেশ মাঠে কাজ করা পুলিশকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছে। এখন আর গুলি চালাতে দ্বিধা থাকবে না।’

তার মতে, দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ সদস্যরা হামলার মুখে আত্মরক্ষায় দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কিন্তু এখন স্পষ্ট নির্দেশ থাকায় তারা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, গত কয়েক মাসে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় টহল ও অভিযানে গিয়ে পুলিশ সদস্যরা বারবার সশস্ত্র হামলার মুখে পড়েছেন। অনেক সময় তারা অস্ত্র হাতে থাকলেও ব্যবহার করেননি, কারণ গুলিতে মৃত্যু হলে আইনি জটিলতা ও তদন্তের চাপের মুখোমুখি হতে হয়। ফলে অনেকেই শেষ মুহূর্তে আত্মরক্ষার পরিবর্তে প্রাণঘাতী ঝুঁকি নিয়ে পিছু হটেছেন।

আরও পড়ুনঃ  কঠোর অবস্থানে সরকার, আতঙ্কে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

ওসি সোলাইমানের মতে, কমিশনার স্যারের এই স্পষ্ট নির্দেশনা সেই মানসিক দ্বিধা ও ভয়কে দূর করেছে। এখন মাঠে থাকা পুলিশ জানবে, যদি কোনো সন্ত্রাসী অস্ত্র বের করে, সে আগ্নেয়াস্ত্র হোক বা ধারালো অস্ত্র তখনই তারা আইনসম্মতভাবে গুলি চালাতে পারবেন। এতে পুলিশ সদস্যরা আগে থেকেই প্রস্তুত থাকতে পারবেন এবং সন্ত্রাসীদের হাতে হতাহতের ঝুঁকি কমবে।

তিনি আরও বলেন, আত্মরক্ষার এই ক্ষমতা শুধু পুলিশ সদস্যদের মনোবল বাড়াবে না, বরং সন্ত্রাসীদের মধ্যেও একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করবে। ‘যখন তারা জানবে পুলিশ আর পিছপা হবে না, তখন তারা আগেভাগেই হামলার চিন্তা থেকে বিরত থাকবে,’ যোগ করেন ওসি সোলাইমান।

তার ভাষায়, এই নির্দেশ কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রামের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত হবে এবং পুলিশের টহল ও অভিযানে সাহস ও কার্যকারিতা দ্বিগুণ হবে।

কোতোয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আব্দুল করিম বলেন, “টহল জোরদার করেছি। প্রতিটি মোবাইল ও পেট্রোল পার্টি এখন আগ্নেয়াস্ত্রসহ বের হচ্ছে।”

তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে নগরের বিভিন্ন এলাকায় ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে সন্ত্রাসীদের হামলা বেড়েছে। এসব ঘটনায় একাধিক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন, যা টহলরত ও অভিযানে থাকা সদস্যদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছিল। কমিশনারের নির্দেশনায় এখন সেই ভয় অনেকটাই কেটে গেছে।

ওসি করিমের মতে, আগ্নেয়াস্ত্রসহ মোবাইল ও পেট্রোল পার্টি নামানো শুধু পুলিশ সদস্যদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, বরং শহরের সাধারণ মানুষের মধ্যেও নিরাপত্তা বোধ বাড়াবে। ‘যখন মানুষ দেখবে পুলিশ পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে রাস্তায় টহল দিচ্ছে, তখন তারাও নিশ্চিন্ত হবে,’ বলেন তিনি।

তিনি আরও যোগ করেন, অস্ত্র হাতে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা থাকলে পুলিশ দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে, হামলাকারীরা হতভম্ব হবে এবং পালানোর পথ খুঁজবে। তাঁর ভাষায়, “এটি একধরনের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। আমরা যখন দেখাব আমরা প্রস্তুত, তখন সন্ত্রাসীরা অস্ত্র হাতে বেরোতেও ভয় পাবে।”

আরও পড়ুনঃ  তাজউদ্দীন কলেজের নাম পরিবর্তন নিয়ে সোহেল তাজের স্ট্যাটাস

ওসি করিম আশা প্রকাশ করেন, এই টহল কৌশল এবং কমিশনারের নির্দেশ একসঙ্গে কার্যকর হলে কোতোয়ালী এলাকা থেকে শুরু করে পুরো নগরেই সন্ত্রাসী হামলার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে।

একজন উপ-পরিদর্শক, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বলেন, “আগে আইনি জটিলতার ভয়ে গুলি করতে ভয় পেতাম। এখন সেই ভয় কাটবে।”

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, অতীতে মাঠে দায়িত্ব পালনকালে অনেক পুলিশ সদস্য আত্মরক্ষার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গুলি চালাতে দ্বিধা করেছেন, কারণ পরে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া, বিভাগীয় তদন্ত ও ব্যক্তিগত চাপের মুখোমুখি হতে হয়েছে। এর ফলে অনেক সময় প্রাণহানির মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু কমিশনারের স্পষ্ট নির্দেশনায় এখন মাঠে থাকা পুলিশ জানবে, আত্মরক্ষায় গুলি চালানো আইনসংগত এবং এর জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।

পেট্রোল ডিউটিতে থাকা এক সার্জেন্ট একই সুরে বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি এমন যে, যে কোনো মুহূর্তে হামলা হতে পারে। এই নির্দেশ দ্রুত কার্যকর হওয়া জরুরি।’

তার মতে, নগরের বিভিন্ন এলাকায় রাতের বেলায় টহল দেয়ার সময় সন্ত্রাসীদের আচরণ অনেকটাই অপ্রত্যাশিত ও হঠাৎ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। তাৎক্ষণিক গুলি চালানোর অনুমতি থাকলে পুলিশ সদস্যরা দ্বিধা না করে মুহূর্তের মধ্যে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবেন।

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যখন জানব যে হামলা শুরু হওয়ার আগেই প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আমাদের আছে, তখন টহল দেওয়া আরও নিরাপদ হবে। এতে শুধু পুলিশ নয়, সাধারণ মানুষও উপকৃত হবে।’ তার মতে, এই নির্দেশ মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন হলে টহলরত সদস্যরা সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন এবং সন্ত্রাসীদের কাছে পুলিশের উপস্থিতি এক ধরনের শক্ত বার্তা যাবে।

এক বছরে অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্য হামলার শিকার

সিএমপির অভ্যন্তরীণ তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পর থেকে অন্তত ৫০ জন পুলিশ সদস্য নগরের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়েছেন। পুলিশের ধারণা, তাৎক্ষণিক গুলি চালানোর নির্দেশ বাস্তবায়ন হলে সন্ত্রাসীদের মধ্যে ভীতি তৈরি হবে এবং হামলার প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে। ১১ আগস্ট রাতে বন্দর থানাধীন ঈশান মিস্ত্রি হাট এলাকায় আওয়ামী লীগের মিছিলে ধাওয়া দিতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হন এসআই আবু সাঈদ রানা।

আরও পড়ুনঃ  গোপালগঞ্জে আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী বলপ্রয়োগে বাধ্য হয়

গত ২৯ মার্চ দিনগত রাত দুইটার দিকে চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার এক্সেস রোড এলাকায় সংঘটিত একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড এখনো স্থানীয়দের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে রেখেছে। সেদিন গভীর রাতে একটি প্রাইভেটকারে থাকা দুর্বৃত্তরা হঠাৎ এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। লক্ষ্য ছিল দু’যুবক মো. আব্দুল্লাহ আল রিফাত ও মো. বখতিয়ার হোসেন ওরফে মানিক। মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাস্থল রক্তে ভেসে যায় এবং তারা দু’জনই ঘটনাস্থলে নিহত হন।

ঘটনার সময় কাছেই পুলিশের একটি টহল গাড়ি উপস্থিত ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, গুলির শব্দ শুনে পুলিশ সদস্যরা মুহূর্তেই বুঝতে পারেন কী ঘটছে। কিন্তু তারা কোনো ধরনের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে দ্রুত সরে যান। পরবর্তীতে তদন্তে জানা যায়, ওই সময়ে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের মধ্যে গুলি চালানোর ব্যাপারে প্রবল ভয় ও দ্বিধা কাজ করছিল। গুলি চালিয়ে কেউ নিহত হলে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া, জটিল তদন্ত এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মুখে পড়তে হবে-এমন আশঙ্কা তাদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল।

এমনকি, শুধু গুলি চালানো নয়, তখনকার পরিস্থিতি এতটাই ভয় ভীতিপূর্ণ ছিল যে ৫ আগস্টের পরে অনেক পুলিশ সদস্য কর্তব্যরত অবস্থায় অস্ত্রও সঙ্গে নিতেন না। টহল বা অভিযানে গেলে তারা শুধু লাঠি বা হাতকড়া নিয়ে বের হতেন, যাতে কোনো অস্ত্র ব্যবহার করতে না হয়। ফলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা অনেক ক্ষেত্রে বিনা বাধায় হামলা চালাতে পারত, এবং পুলিশ কেবল ঘটনাস্থল থেকে সরে গিয়ে পরবর্তীতে তদন্ত করত।

এই প্রেক্ষাপটেই সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজের স্পষ্ট নির্দেশনা মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি পাল্টে দিয়েছে। এখন পুলিশ জানে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক গুলি চালানো আইনসংগত এবং এর জন্য তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি এই নির্দেশ ২৯ মার্চের আগেই কার্যকর থাকত, তবে বাকলিয়ার এক্সেস রোডের ওই রাত হয়তো ভিন্নভাবে শেষ হতে পারত।

আপনার মতামত লিখুনঃ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ