Sunday, July 27, 2025

রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে মূল প্রশ্ন হওয়া উচিত আপনাদের অর্থায়ন কে করছে?

আরও পড়ুন

ড. মুশতাক হুসেন খান ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) অর্থনীতির অধ্যাপক। এ ছাড়া অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, থাইল্যান্ডে চুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপনা করেছেন। পড়াশোনা করেছেন অক্সফোর্ডের কর্পাস ক্রিস্টি কলেজ ও কেমব্রিজের কিংস কলেজে। দীর্ঘ দিন তিনি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনিই প্রথম ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ কথাটি চালু ও বিশ্লেষণ করেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি, গোষ্ঠীগত রাজনীতি, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, সুশাসন, শিল্পনীতি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, দুর্নীতি দমন বিষয়ে তাঁর রয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবন্ধ। সমকালের পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সহসম্পাদক ইফতেখারুল ইসলাম।

সমকাল: নিচ থেকে ক্ষমতার বিন্যাসের পরিবর্তন প্রশ্নে আমরা আগের কিস্তি শেষ করেছিলাম। ওপর দিক থেকে পরিবর্তনগুলো কীভাবে আসে?
মুশতাক খান: ওপর থেকে পরিবর্তন তখনই আসে, যখন ক্ষমতাসীন বলয় বা এস্টাবলিশমেন্ট দুর্বল হয়ে পড়ে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর এ রকম একটি সুযোগ ছিল।

সমকাল: ছিল বলছেন কেন? এখন কি নেই?

মুশতাক খান: এখনও আছে; আগের চেয়ে কম। সুযোগটা হয়তো আরও দুই-তিন বছর থাকবে। এখানে যদি আমরা ফোকাস করতাম বা এখনও করি এবং অর্থনীতি ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত পাঁচ থেকে ১০ জন বড় চোর ধরতে পারি, যারা ব্যাপক হারে দুর্নীতি করেছে, তাহলে এভাবেও ক্ষমতার কাঠামোতে পরিবর্তন আসতে পারে। এই অলিগার্কদের কয়েকজনের অর্থ জাতীয়করণ বা জব্দ করতে পারলে সবাই সিগন্যাল পেয়ে যেত– চুরি করে টাকা করলে বিচারের সম্ভাবনা আছে। এভাবেও ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টানো যায়।

সমকাল: এখন কি সেই সুযোগটা আছে?

মুশতাক খান: এখনও আমি মনে করি, সুযোগ আছে। এত চুরির পরও যদি তারা পার পেয়ে যায়, তাহলে ওই ক্ষমতা কাঠামোতে ভবিষ্যতে আঘাত করা অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। এটি না করতে পারলে অলিগার্করা চুরির টাকা খরচ করবে রাজনৈতিক দল কিনে ফেলতে। আগে তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল, এখন তাদের পয়সা বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যাবে। এটি যে যাচ্ছে, তার গন্ধ তো আমরা পাচ্ছি। তাই কিনা? তখন তাদের বিরুদ্ধে যাবে না। অথবা যতটা সম্ভব ততটা যাবে না।

সমকাল: আমরা কি তাহলে আগের জায়গায় ফিরে যাচ্ছি?

মুশতাক খান: আমরা আগের জায়গায় পুরোপুরি ফিরে যাব না। আমরা যদি শাস্তি নাও দিতে পারি, অলিগার্করা আবার আগের মতো চুরি করতে পারবে না; দুটি কারণে। আমাদের অর্থনীতি আর বিশ্ব অর্থনীতি এখন খুবই নাজুক অবস্থায়। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক, তারা যদি উৎপাদনক্ষমতা দ্রুত বাড়াতে না পারে; যদি চুরি করতে থাকে, অর্থনৈতিক ধস নেমে আসবে। দ্বিতীয়ত, জুলাই অভ্যুত্থানে লাখো লোক রাস্তায় নেমেছে, রক্ত দিয়েছে। অর্থনৈতিক ধস নেমে আসবে, আর সবাই বাড়িতে বসে থাকবে– এ রকম হবে না। অভ্যুত্থানেই ক্ষমতার বিন্যাস কিছুটা পাল্টে গেছে। রাজনৈতিক সরকার উন্নয়ন, চাকরি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য না দিতে পারলে খুব দ্রুত লোক রাস্তায় নামবে।

সমকাল: তাহলে কি ক্লায়েন্টালিস্ট পলিটিক্সের অবসান ঘটানো সম্ভব?

মুশতাক খান: ক্লায়েন্টালিজম আমাদের পলিটিক্সে কিছুটা থাকবে। কিন্তু আমরা যে পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম– ব্যাংক চুরি, বৈদেশিক মুদ্রা চুরি, দ্বিগুণ বা তিনগুণ দামে বিদ্যুৎ আর অবকাঠামোর চুক্তি, এটি আর অর্থনীতি বা সমাজ হজম করবে না। আমরা ক্লায়েন্টালিজম ছাড়িয়ে স্টেট ক্যাপচারে চলে গিয়েছিলাম।

সমকাল: দুটোর মধ্যে তফাত কী?

মুশতাক খান: আমাদের দেশে ২০০৬ পর্যন্ত ক্লায়েন্টালিজম ছিল। আওয়ামী লীগ আসত, পাঁচ বছর চুরি করত; আবার বিএনপি আসত, পাঁচ বছর চুরি করত। দুই দলই জানত, বেশি বাড়াবাড়ি করলে পরবর্তী সরকার তাকে বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে যাবে। দুর্নীতি, মারামারি-কাটাকাটি, খুনোখুনি, রাহাজানি সবই করত। কিন্তু একটা সীমা ছিল। ২০০৯ সালের পর সেই সীমাটা চলে যায়। আওয়ামী লীগ খুব সফলভাবে বিএনপি সমর্থকদের জেলে দেয়, পেটায়, ব্যবসা-বাণিজ্য কেড়ে নেয়, জামায়াতকে ফাঁসি দেয়, মেরে ফেলে, গুম করে। যারা কোনো দল করে না, তারাও গুম হয়ে যায় বেশি কথা বললে। নিপীড়ন এত ব্যাপক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আওয়ামী লীগবিরোধী বলে কিছু ছিল না। দলটি অভূতপূর্ব হারে নিয়ম-কানুন ভাঙতে পেরেছে। ব্যাংক চুরি, রিজার্ভ চুরি, বিচার বিভাগ চুরি, নির্বাচন চুরি, প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে তাদের লোক। এটিই স্টেট ক্যাপচার; একটা দল রাষ্ট্রের সব সংগঠন দখল করে বসেছে।

আরও পড়ুনঃ  ব্রেকিং নিউজ: রাতে যে কারণে জরুরি বৈঠক ডাকল বিএনপি

সমকাল: আওয়ামী লীগ তো এখন নেই।

মুশতাক খান: দলটির সুপ্ত সংগঠন ও সমর্থক তো রয়েছে; যারা তাদের অর্থ দিত তারাও আছে। আওয়ামী সমর্থকরা অন্য দলে ঢুকে পড়তে পারে; নতুন দল করতে পারে। অন্য কোনো দল টাকা নিয়ে একই অলিগার্কের স্বার্থে কাজ করতে পারে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নেই বলে ক্ষমতার বিন্যাস সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে, কেউ মনে করে না।

সমকাল: তাহলে কী ধরনের পদক্ষেপের কথা বলছেন?

মুশতাক খান: ক্ষমতার কাঠামোর কোনো পরিবর্তন যদি না হয় তাহলে আমরা ব্যর্থ হবো। রাজনৈতিক বন্দোবস্ত পরিবর্তনের জন্য আমাদের কিছুটা হলেও ক্ষমতার বিন্যাসে পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু কোন দল ক্ষমতায় আছে, সেটি দেখলে হবে না। দলের পেছনে ক্ষমতার বিন্যাস; সে কার স্বার্থে কাজ করছে; সে কি নিয়ম ভঙ্গকারীদের রোধ করবে, না সহায়তা করবে– এসব বুঝতে হবে।

সমকাল: এই মুহূর্তে পরিবর্তন সম্ভব?

মুশতাক খান: অবশ্যই সম্ভব। বাংলাদেশে এখন দরকার নতুন খাতে শিল্পায়ন। এটি হওয়া উচিত এসএমই খাতের ‍উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক, তাদের কর্মসংস্থানের দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা জানি, এটি মাঝারি আকারের ব্যবসার মাধ্যমেই সম্ভব। আমাদের হাজার হাজার নতুন ব্যবসায়ীর আগমন নিশ্চিত করতে হবে। একটা বিষয় খেয়াল করেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রছাত্রী ছাড়াও বিপুলসংখ্যক দোকানদার আর খেটে খাওয়া মানুষ শরিক হয়েছিল। তারা তো নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চায়। তাদের নতুন প্রযুক্তি আর প্রশিক্ষণ দিলে ক্ষমতার বিন্যাস পাল্টাতে শুরু করবে।

সমকাল: ব্যবসায়ীরা আলাদাভাবে কী ধরনের বন্দোবস্ত চায়?

মুশতাক খান: তারা আলাদা বন্দোবস্ত চায় না; তারা বেঁচে থাকতে চায়। তারা যে বিভিন্ন হয়রানির মুখোমুখি হয়, চাঁদাবাজির শিকার হয়, সিন্ডিকেটের প্রতিযোগিতায় মার খায়; পুরো দিন শ্রম-ঘাম দিয়ে শুধু বেঁচে থাকতে পারে। এটি তাদের বনাম দুর্বলতা আর চোরা ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ আর সিন্ডিকেটের ক্ষমতার প্রতিফলন। অথচ যৌথভাবে ছোট ব্যবসায়ীরা একটা শক্তিশালী গোষ্ঠী। পরিবর্তন বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই সম্ভব যদি কোনো একটি দল বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ আর সুযোগগুলো ঠিকভাবে বোঝে এবং ছোট আর মাঝারি ব্যবসায়ীদের সংগঠিত করতে শুরু করে।

সমকাল: সংগঠিত করার জন্য কী কী দরকার?

মুশতাক খান: ব্যতিক্রমধর্মী রাজনৈতিক নেতৃত্ব দরকার। ওই ক্লায়েন্টালিস্ট নেতৃত্বই থাকতে পারে, কিন্তু তাদের অন্তত এটুকু বুঝতে হবে, সমাজের উৎপাদনশীল শক্তি সংগঠিত করতে পারলে তাদেরই রাজনৈতিক লাভ হবে, দেশেরও লাভ। কিন্তু প্রতিটি দলই যদি বিপুলসংখ্যক টাকা অলিগার্ক বা অনুৎপাদনশীল ব্যবসায় গোষ্ঠীর কাছ থেকে পায়, তারা তো এদিকে ঝুঁকবে না।

সমকাল: অলিগার্ক বলয়ের ব্যাপারে করণীয় কী?

মুশতাক খান: আমি মনে করি, আমাদের অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক পথ পরিবর্তন করতে হবে। নিচ থেকে পরিবর্তন আরও দ্রুত হবে যদি আমরা ওপর থেকেও অলিগার্কদের ক্ষমতা কমাতে পারি। নতুন আইন, নতুন সংবিধান হয়তো লাগবে, কিন্তু ক্ষমতার যে অতিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে, তা পরিবর্তন না করতে পারলে নতুন আইন আর সংবিধান কাগজে সীমিত থাকবে।

সমকাল: তবুও ক্লায়েন্টালিস্ট পলিটিক্সের অবসান ঘটছে না?

মুশতাক খান: ক্লায়েন্টালিস্ট পলিটিক্স কালকেই চলে যাবে না। আমরা যদি কালকেই উন্নত দেশের আইনের শাসন চাই, ব্যর্থ হবো, হতাশ হবো। ইতিহাসে দেখি, ক্লায়েন্টালিস্ট পলিটিক্সের মৌলিক পরিবর্তন হতে হলে মোটাদাগে মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলার হতে হবে। যখন মাথাপিছু আয় এখানে পৌঁছাবে তার মানে হচ্ছে, আপনার ব্যাপক শিল্পায়ন হয়েছে। তখন ক্ষমতাশীলরাই নিজের স্বার্থে আইনের শাসন চায়, বিপুল অঙ্কের ট্যাক্স দেয়, একজন আরেকজনের আইন লঙ্ঘন ধরিয়ে দেয়। এখন আমাদের যেটি করতে হবে, সেটি হলো ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীকরণ কমাতে হবে; ছোট আর মাঝারি ব্যবসায়ীদের পক্ষের উন্নয়নশীল রাজনীতি নিয়ে আসতে হবে। অলিগার্ক, প্রশাসন, রাজনীতিকদের অশুভ জোটগুলো ভাঙতে হবে।

আরও পড়ুনঃ  ‘জিয়াউর রহমান জামায়াতে ইসলামীর জন্মদাতা’, বিএনপি নেতার বক্তব্য ভাইরাল

সমকাল: ক্লায়েন্টালিস্ট পলিটিক্সে রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যাপারে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

মুশতাক খান: আওয়ামী লীগও এক ধরনের ক্লায়েন্টালিস্ট পলিটিক্স করত। কিন্তু প্রতিযোগীদের শেষ করে তারা একটা বীভৎস রূপ নিয়েছিল, যেটি স্টেট ক্যাপচারে পৌঁছেছিল। আগেই বলেছি, আমাদের কোনো দলই ক্লায়েন্টালিস্ট পলিটিক্সের বাইরে না। সেটি বিএনপি বলেন, এনসিপি বলেন, জামায়াত বলেন– সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং ইউটোপিয়ান আশা নিয়ে সবসময় সমালোচনা করা উচিত না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমাদের মূল প্রশ্ন হওয়া উচিত, আপনি ক্ষমতায় এসে কী কাজটা করবেন? এটি করার জন্য আপনাদের কে সমর্থন দিচ্ছে, কে অর্থায়ন করছে? আপনার ক্ষমতার ভিত্তি কী? এসএমই, নাকি অলিগার্ক?

সমকাল: আপনি বলছেন, অলিগার্কদের বিপরীতে এসএমই ও অর্থনীতির অন্যান্য খাত গড়ে উঠলে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত পরিবর্তিত হবে?

মুশতাক খান: এ ছাড়া তো কোনো উপায় নেই। শ্রমিক-কৃষক বিপ্লব আজকের জগতে হবে না। কিন্তু মধ্যম ব্যবসায়ীর উত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার অশুভ বিন্যাসকে বদলানো সম্ভব। তা না করে আমরা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোকে বলব, আপনারা ঐকমত্যে আসেন; প্রতিশ্রুতি দেন– ভালো কাজ করবেন, আইন মেনে চলবেন, কিন্তু তাদের অর্থ আর ক্ষমতার উৎস আগের মতোই থেকে গেল, তাহলে কি আসলেই পরিবর্তন হবে? আমি আশা করি, অন্তত একটি দলের নেতৃত্ব বুঝবেন যে আগের অলিগার্কচালিত অর্থনীতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই। যেই দল এসএমই ব্যবসায়ীদের সংগঠিত করবে, নতুন সেক্টরে প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ আর সাংগঠনিক সক্ষমতা আনার ব্যবস্থা করবে, তারা বিপুল ভোট পাবে। তাদের চেষ্টা করতে হবে ছোট, মাঝারি ব্যবসায়ী আর সংস্কারপন্থি নাগরিকের কাছ থেকে আইনিভাবে টাকা তুলে রাজনীতি করার। উৎপাদনশীল খাতকে ট্যাক্সের অধীনে এনে শিক্ষা আর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ভালো করতে হবে, দুর্নীতি কমাতে হবে।

সমকাল: তরুণরা সংসদে দ্বিকক্ষের প্রস্তাব দিচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?

মুশতাক খান: আপনি এক কক্ষ, দুই কক্ষ এবং কে কাকে সংসদে ব্যালান্স করছে– এগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন না যদি আসল জায়গায় ক্ষমতা আগের মতো থাকে। কারণ অলিগার্কের টাকায় যদি ক্ষমতায় বসতে হয়, আপনার সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক, কিছুই হবে না। এক কক্ষ যেমন তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, দুই কক্ষের একই হাল হতে পারে। তাই আমি রাজনৈতিক বন্দোবস্তকে ক্ষমতার বিন্যাস হিসেবে বুঝি; চুক্তি বা সমঝোতা বা সংবিধান হিসেবে না। এর পরিবর্তন নিচ আর ওপর, দুই দিক থেকে সমান্তরালভাবে হতে হবে। এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে সংবিধান, আইন সবই পরিবর্তন করতে হবে। ক্ষমতা আগের মতো থেকে গেল; আমরা আইন আর সংবিধানে অনেক পরিবর্তন নিয়ে এলাম, তার ফলে আসল কোনো পরিবর্তন নাও হতে পারে।

সমকাল: দুর্নীতি কি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব?

মুশতাক খান: আমি দুর্নীতিকে কালকেই শূন্যে আনতে পারব না। কিন্তু কেউ যখন সীমা অতিক্রম করে তাকে জানতে হবে– জনগণ তাকে ভয়াবহ শাস্তির মুখোমুখি করবে। এটি যদি আমরা করতে না পারি, তাহলে কোনো কিছুই হবে না। ক্ষমতার অপপ্রয়োগ থামাতে হবে অলিগার্কদের বিপরীত গোষ্ঠীদের শক্তি প্রদর্শন করে। আমার জন্য রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তনের এটিই আসল পদক্ষেপ। এটি করার পর অনেক কিছু করা সম্ভব। কারণ, ওইটাই সিগন্যাল যে, ক্ষমতার পরিবর্তন হচ্ছে আর হবে।

আরও পড়ুনঃ  বিএনপির রাজনীতিতে নতুন মোড়

সমকাল: এর পর কী হবে?

মুশতাক খান: এর পর কোনো এক সাহসী দলকে ভিন্ন পথে চলতে হবে। ক্ষমতায় এসে তাদের নতুন অর্থনৈতিক খাত, নতুন জনশক্তি তৈরি করতে হবে। যেসব তরুণ-তরুণী চাকরির জন্য রাস্তায় নেমেছিল তাদের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের নিজস্ব মাঝারি ব্যবসা গড়ে তোলার সকল সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। তারাই তো বৈষম্যহীন সমাজ চেয়েছিল। তাহলে তাদের চাকরির ব্যবস্থা, তাদের উদ্যোক্তা হবার ব্যবস্থা করেন। এসব চাকরি কোত্থেকে আসবে, এসব উদ্যোক্তা কীভাবে দাঁড়াবে যদি আগের অলিগার্করা বহাল থাকে আর সব আর্থিক সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করে? আপনারা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এই প্রশ্ন তোলেন। যারা সবচেয়ে ভারতবিরোধী তাদেরও ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয় কেন? আমাদের স্বাস্থ্য খাতের এই অবস্থা কেন? হাজার কোটি টাকা খরচ করছি। কেন দেশে চিকিৎসা করাতে পারব না? এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর পরিকল্পনা কী?

সমকাল: আপনি কি বলছেন, কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলোর নীতির ওপর জোর দিতে হবে?

মুশতাক খান: একদমই না। বরং আমি আলাদা কিছুই বলছি। আমি মনে করি, এখানে যে কাঠামোগত ব্যাপারগুলো রয়েছে, আমাদের উৎপাদনশীল ক্ষমতার যে বিন্যাস আছে, এখানে আপনি সম্পূর্ণ ট্যাক্সভিত্তিক সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পলিটিক্স বাস্তবে কালকেই আনতে পারবেন না। কোনো দেশেই হয়নি। আপনার মাথাপিছু আয় ১০ হাজার ডলার হলে যথেষ্ট ট্যাক্স আসবে। সেই ট্যাক্সের ভিত্তিতে আপনি ইশতেহার দেবেন, যা দেখে মানুষ আপনাকে ভোট দেবে। আর তারা বলবে, রাজনীতিবিদ, প্রশাসক আমার সেবাদানকারী। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাজনীতি হলো সেবাদানের একটি পেশা। সেটি কখন ঘটে? যখন নাগরিক জানে, রাজনীতিক তাঁর টাকায় বেঁচে থাকে। তখন সে সরাসরি বলতে পারে, আমি আপনাকে খাওয়াচ্ছি, বেতন দিচ্ছি। আপনি আমার চাহিদামতো কাজ করবেন। এখন বেশির ভাগ রাজনীতিকের আয় আমার-আপনার ট্যাক্স থেকে আসছে না। তারা ক্লায়েন্টালিজমের যে পদ্ধতি গড়ে তুলেছে, চাঁদাবাজি আর বড় ব্যবসায়ীর সমর্থন, সেখান থেকে আসছে। তার ফলে রাজনীতিককে আমরা কালকেই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। বরং তারা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। এই নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে; অর্থ আর ক্ষমতার নতুন সূত্র তৈরি করতে হবে। আগেই বলেছি, গোষ্ঠীতান্ত্রিক রাজনীতির মধ্যে অনেক ধরন আছে, অনেক পার্থক্য আছে। যেসব পরিবর্তন বাস্তবে হাসিল করা সম্ভব, সেগুলোতেই আমাদের জোর দিতে হবে।

সমকাল: তাহলে এই কাঠামোগত সমস্যার সমাধান কী?

মুশতাক খান: আমরা স্টেট ক্যাপচার আর ফ্যাসিজম থেকে বের হচ্ছি। যেন তা না হয়, আমাদের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিযোগিতা হলে, বিএনপি চাঁদাবাজি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে এনসিপি তাদের ঠেকাবে। আবার এনসিপি বাড়াবাড়ি করলে জামায়াত বা বিএনপি তাদের ঠেকাবে। সুতরাং রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা হলো ক্লায়েন্টালিস্ট রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার তাৎক্ষণিক উপায়। বাংলাদেশে একদলীয় পদ্ধতি কোনোদিন কাজ করেনি। একদলীয় রাজনীতি কাজ করে যেখানে ক্লায়েন্টালিস্ট রাজনীতি একটা অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধ দল নিয়ন্ত্রণ করে, যেমন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। আমাদের সামাজিক কাঠামোতে এ রকম দল সম্ভব না। তাই যখনই আমাদের মতো দেশে একদলীয় শাসন হয়েছে, তার পরিণাম সবসময় খুব খারাপ হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক বন্দোবস্তে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করাই সবচেয়ে ভালো রাজনৈতিক পন্থা।

সমকাল: এই প্রতিযোগিতা কি লক্ষ্য করা যায়?

মুশতাক খান: আমাদের প্রতিযোগী দলগুলোর মধ্যে মোটামুটি ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে, তবে সেটি যথেষ্ট নয়। তারপর আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে চাপ দিতে হবে নতুন উৎপাদনশীল শক্তি, খাত তৈরি করতে হবে তাদের দলীয় স্বার্থে আর দেশের স্বার্থে। জনগণই বারবার রাস্তায় নেমে রাজনৈতিক দলগুলোকে বেকায়দায় ফেলে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে পারে। শুধু সংবিধানের আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না।

আপনার মতামত লিখুনঃ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ