Sunday, August 17, 2025

‘বাড়ির সবাইকে বলেছিলাম দ্রুত সরে যেতে, ফিরে দেখি কিছুই নেই’

আরও পড়ুন

পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বুনের জেলার বেশন্ত্রি গ্রামের মসজিদের ইমাম মওলানা আব্দুস সামাদ তখন মসজিদে। এর মধ্যে আকস্মিক বন্যার খবর পান। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য গ্রামবাসীর মতো নিজের পরিবারকেও দ্রুত বাড়ি খালি করার নির্দেশ দেন।

নামাজ শেষ করে কিছুক্ষণ পরইবাড়ি ফিরে আসেন তিনি। ফিরে দেখতে পান আকস্মিক বন্যার পানির তোড়ে তার বাড়িসহ অনেকের বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। বেশন্ত্রি গ্রামটি বুনের জেলার পীর বাবা সাহেব উপজেলায় পড়েছে।

বর্ষা মৌসুমে প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে গত বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) পাকিস্তানে আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। পাকিস্তানের সরকারি হিসাবে, বন্যার কারণে গত ৪৮ ঘণ্টায় ৩২১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

এর মধ্যে বেশিরভাগ মৃত্যুই হয়েছে পাহাড়ি খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বিভিন্ন জেলায়। প্রাদেশিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ (পিডিএমএ) জানিয়েছে, পাহাড়ি অঞ্চলে এখন পর্যন্ত ৩০৭ জনের মৃত্যু এবং ২৩ জন আহত হয়েছেন। এসব হতাহতের ঘটনা মূলত বাড়ি ধসের কারণে হয়েছে।

সরকারি হিসাবে, আকস্মিক বন্যার কারণে প্রদেশের সোয়াত, বুনের, বাজাউর, তোরঘর, মানসেহরা, শাঙলা ও বটগ্রাম জেলায় এখন পর্যন্ত মোট ৭৪টি বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৬৩টি আংশিক এবং ১১টি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।

বুনের জেলার বেশন্ত্রি গ্রামে স্থানীয় মসজিদের ইমাম আব্দুস সামাদের বাড়িটিও আকস্মিক বন্যায় ভেসে গেছে। এ সময় তার পরিবারের পাঁচজন সদস্য ছিলেন বাড়ির ভেতরে ছিলেন। পানির তোড়ে তারাও ভেসে গেছেন। তাদের এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা কোথায় কীভাবে আছে, তা কেউ জানে না।

পীর বাবা সাহেব উপজেলার সাবেক কর্মকর্তা বা তহসিল নাজিম আশফাক আহমদ। বন্যার সময় তিনি রাজধানী ইসলামাবাদে ছিলেন। যখন তিনি তার বাড়ি থেকে খবর পান যে বিশাল বন্যা হানা দিতে পারে, তিনি তখনই তার পরিবারকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

আরও পড়ুনঃ  ইরানের সমরাস্ত্র ভান্ডার নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলেন আইআরজিসির উপদেষ্টা

কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন নি আশফাক আহমদ। কিন্তু কারও কোনো সাড়া মেলেনি। এমনকি পুরো গ্রামের কাউকে ফোনে পাওয়া যায়নি। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে তিনি যখন গ্রামে পৌঁছান, তখন সর্বত্র ধ্বংসের চিহ্ণ দেখতে পান। পুরো গ্রাম ধ্বংস, বাড়ি-ঘর বিধ্বস্ত। আহতরা এখানে-সেখানে লুটিয়ে পড়ে আছে।

আশফাক আহমেদ জানান, বন্যার সময় আশফাক আহমদের বাড়িতে ১৪ জন লোক ছিল। তাদের মধ্যে চারজনের লাশ পাওয়া যায়। বাকি ১০ জন এখনও নিখোঁজ। বন্যার সময় গাছে ওঠার কারণে প্রতিবেশী একটি পরিবারের দুই সদস্য বেঁচে গেছেন। আর বাকি নয়জন সদস্য নিখোঁজ হয়েছেন।

‘অগণিত মানুষ এখনও নিখোঁজ’

প্রদেশেটিতে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত জেলা বুনেরের জরুরি উদ্ধারকারী বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলোর মধ্যে একটি হলো বেশন্ত্রি গ্রাম। গ্রামটিতে মানুষের জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করার জন্য মতো কেউ ছিল না। পাশের গ্রামের মানুষ এসে এসব কাজে সাহায্য করেছেন।

সাহায্যকারীদের মধ্যে ছিলেন বুনেরের ব্যবসায়ী নূর ইসলাম এবং বিদেশ থেকে ছুটিতে বাড়ি আসা মুহাম্মদ ইসলাম। তারা দুর্গত গ্রামবাসীর সহায়তার এগিয়ে আসেন। নূর ইসলাম জানান, তিনি দুপুর ১টার দিকে বেশন্ত্রি গ্রামে পৌঁছান। তখন সেখানে একটা বাড়িও অক্ষত ছিল না।

তার কথায়, ‘সন্ধ্যা নাগাদ আমি আমার বন্ধুবান্ধব এবং স্থানীয় লোকেদের সাথে বেশ কয়েকটি জানাজায় অংশ নিয়েছি। আমার সংখ্যাটিও মনে নেই, যদিও আমি নিজে ছয়টি কবর খননে সাহায্য করেছি। আমি সকাল ১১টায় বন্যার খবর পাই। এর সাথে সাথে এলাকার মসজিদগুলোয় ঘোষণা দিয়ে জানানো হয়। এরপর আমি অন্যান্য মানুষদের সাথে বেশন্ত্রি গ্রামের দিকে হেঁটে যাই।’

নূর ইসলাম আরও বলেন, ‘বেশন্ত্রি গ্রামটি পীর বাবা সাহেব সদর উপজেলা থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু আকস্মিক বন্যার কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সর্বত্র ধ্বংসের চিহ্ন। ফলে ‌আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পৌঁছাতে দুপুর ১টা বেজে যায়। আমাদের আগেই সেখানে আরও অনেক লোক চলে এসেছিলো যারা ত্রাণ কার্যক্রমে ব্যস্ত ছিল।’

আরও পড়ুনঃ  উড্ডয়নের পরপরই বিমান বিধ্বস্ত, সব আরোহী নিহত

তিনি আরও বলেন, ‘সেখানকার দৃশ্য ছিল ভয়াবহ। আমি দেখেছি আহতরা মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। যারা সেখানে পৌঁছেছিল তারা আহতদের তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিল, আবার অনেকে ধ্বংসস্তূপ থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করছিল।’

নূর ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে বেশন্ত্রি গ্রামের মসজিদের ইমাম মওলানা আব্দুস সামাদকে চিনতেন। তিনি বলেন, ‘তিনি আমাকে বলেন, যখন বন্যার পানি আসছিল, তখন পানির তোড় খুব একটা বেশি ছিল না। তিনি পরিবারের সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন তারা যেন এলাকার অন্যান্য লোকদের মতো তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে চলে যান। তিনি নফল নামাজ পড়া শেষ করে আসবেন।’

নূর ইসলাম আরও বলেন, ‘আমি পীর বাবা সাহেব উপজেলার সাবেক কর্মকর্তা বা তহসিল নাজিম পীর বাবা আশফাক আহমেদের পরিবারের সদস্যদের কবর খননে সাহায্য করেছি। দুর্ঘটনার সময় আশফাক আহমেদ ইসলামাবাদে ছিলেন। তার পরিবারের দশজন সদস্য এখনো নিখোঁজ।’

তিনি বলেন, ‘গ্রামে প্রায় সব বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে এমন বাড়ির সংখ্যা খুব কমই রয়েছে যেখানে পরিবারের কেউ নিখোঁজ নেই। স্পষ্টতই, নিখোঁজদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।’

বুনারের জরুরি উদ্ধার বিভাগের তথ্য মতে, অনেক মানুষ তাদের পরিবারের সদস্যদের, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু, তাদের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। বহু মানুষ এখনো তাদের পরিবারের সদস্যদের খুঁজে পাচ্ছেন না।

‘এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি’

উদ্ধারকারী বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বুনের জেলার বেশন্ত্রি গ্রামের মোট জনসংখ্যা প্রায় এক হাজার। মুহাম্মদ ইসলাম জানান, তিনি দুপুর আড়াইটায় সেখানে পৌঁছান। পুরো গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়েছিলো তখন, যেন এক মৃত্যুপুরি। সেই দৃশ্য ছিল ভয়াবহ ও মর্মস্পর্শী।

তার ভাষ্য, ‘সেখানকার সব ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা মৃতদেহ রাখার জন্য উপযুক্ত কোনো জায়গা ছিল না।’ দুর্গত মানুষদের সাহায্যে শত শত মানুষ এগিয়ে এসেছিল এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই মৃতদেহ উদ্ধার ও কবর খোঁড়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন।

আরও পড়ুনঃ  গাজায় এক মায়ের আর্তনাদ ‘আমার বাচ্চারা এক সপ্তাহ ধরে কিছু খায়নি’

মুহাম্মদ ইসলাম আরও জানান, তার এক আত্মীয়ের পরিবারের মধ্যে কেবল দুই শিশু বেঁচে গিয়েছিলো, কারণ তারা বন্যার সময় গাছে চড়েছিল। তার কথায়, ‘তারা আমাদের বলেছে যে ধ্বংসস্তূপের নিচে ছয়টি মৃতদেহ রয়েছে। আমরা সেই মৃতদেহগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু খুঁজে পাইনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার আরেক বন্ধু, সাহেবজাদা আশফাক আহমেদ, যিনি নিজে ইসলামাবাদে থাকেন। তার পরিবারের ১৩ জন সদস্য রয়েছেন, যাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র চারজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে। অন্যদিকে পরিবারের শিশু এবং নারী সদস্যরা এখনো নিখোঁজ।’

নূর ইসলাম জানান, তিনি ও তার সহযোগীরা ওই পরিবারের সদস্যদের মৃতদেহ উদ্ধার ও তাদের দাফনের ব্যবস্থা করতে সাহায্য করেছেন।

জরুরি উদ্ধার বিভাগ বা রেসকিউ ১১২২ বুনারের কর্মকর্তা আব্দুর রহমান জানান, বেশন্ত্রি ছাড়াও অন্যান্য কয়েকটি গ্রামও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের উদ্ধারকারী দল ইতোমধ্যেই দুর্গত অঞ্চলে পৌঁছেছে। পাশাপাশি প্রদেশের অন্যান্য এলাকা থেকেও উদ্ধারকারী দল আসছে। ‘কিন্তু পরিস্থিতি খুবই সংকটজনক,’ বলেন আব্দুল রহমান।

‘রাতের অন্ধকারে উদ্ধারকাজে অসুবিধা হচ্ছে। মোবাইল সিগন্যাল খুব দুর্বল এবং বিদ্যুৎ সংযোগের সমস্যার মধ্যে উদ্ধার কাজ চলছে। হাসপাতালে ক্রমাগত মৃতদেহ ও আহতদের আনা হচ্ছে এবং তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।’

ভারি বৃষ্টিপাত ও আকস্মিক বন্যার কারণে পিডিএমএ খাইবার পাখতুনখোয়ার বাজাউর ও বটগ্রাম জেলাকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত জেলা হিসেবে ঘোষণা করেছে। সংস্থাটি আরও জানিয়েছে, বাজাউর ও বুনার জেলায় ত্রাণ কাজের জন্য হেলিকপ্টারও পাঠানো হয়েছে, যেখানে উদ্ধার অভিযান চলছে।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

আপনার মতামত লিখুনঃ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ