Friday, July 4, 2025

ইসরায়েলের প্রযুক্তির বড়াই যেভাবে ধূলিসাৎ করে দিল ইরান

আরও পড়ুন

কোনো ধরনের উসকানি ছাড়াই গত ১৩ জুন ইরানে হামলা চালায় ইসরায়েল। এ হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানাতে কালক্ষেপণ করেনি তেহরান। মুহূর্তেই তেল আবিবের দিকে বৃষ্টির মতো ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়।

ইরানের এই হামলায় তেল আবিবের দক্ষিণে অবস্থিত রিহবেত শহরে ইসরায়েলের বিখ্যাত সামরিক-সংশ্লিষ্ট গবেষণাগার ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স ‘পুরোপুরি ধ্বংস’ হয়ে গেছে।

সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্সের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ইসরায়েলি শাসনব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক ও সামরিক গবেষণার মূল ভিত্তি হিসেবে গড়ে ওঠা এই প্রতিষ্ঠানটি এখন কার্যত অচল ও বিধ্বস্ত।

ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের দাবি, ইরান ভুল করে ওই ইনস্টিটিউটে হামলা চালায়নি। বরং সুপরিকল্পিতভাবেই এ হামলা চালানো হয়। যার লক্ষ্য ছিল পদার্থবিদ্যা, বায়োটেকনোলজি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ সামরিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ এই কেন্দ্রটিকে গুড়িয়ে দেওয়া। এতে সফলও হয়েছে ইরান।

তেহরানের চালানো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ভবনটির গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইসরায়েলি টেলিভিশন চ্যানেল ১৩–কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমন তথ্য জানান ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট আলোন চেন।

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রাথমিক মূল্যায়ন ৩০০ মিলিয়ন ডলার থেকে অর্ধ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষতির ইঙ্গিত দেয়।’

চেন বলেন, ভবনটির দুটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। এর মধ্যে একটি ছোট আবাসিক ও অন্যটি বৃহৎ বৈজ্ঞানিক অংশ। তবে ইরানের হামলায় তুলনামূলকভাবে বড় অংশটিতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তারা ইনস্টিটিউটের হৃৎপিণ্ডকে লক্ষ্যবস্তু করেছে। তাদের হামলা ছিল অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট।

তিনি আরও বলেন, ইরানের হামলায় শুধু ভাইসমান ইনস্টিটিউটই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। অনেক সামরিক ঘাঁটি ও কৌশলগত স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেগুলো এখনো প্রকাশ্যে আনা হয়নি।

বিধিনিষেধ সত্ত্বেও যেসব ছবি ও ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ফুটে উঠেছে।

আরও পড়ুনঃ  নতুন করে ইসরায়েলে হামলা, দেশজুড়ে সতর্কতা জারি

কয়েক দশকের গবেষণার ক্ষতি

ইরানের হামলায় ইসরায়েলের একটি নবনির্মিত রাসায়নিক ও ভৌত বিজ্ঞান গবেষণাগার প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এটি এ বছরই চালু হওয়ার কথা ছিল।

জীবন ও গণনামূলক বিজ্ঞানচর্চার জন্য নিবেদিত ভবনও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্তত একটি ল্যাবে আগুন লেগেছে। এই স্থাপনাটিতে ক্যানসার ও কোষ পুনরুৎপাদনের ওষুধসহ গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকল্প চলছিল।

সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ‘কার্ডিয়াক রিজেনারেশন’ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এলদাদ জাহরের। তার ২২ বছরের গবেষণার ফসল—হৃৎপিণ্ডের হাজারো টিস্যু, ডিএনএ ও আরএনএ, অ্যান্টিবডি ও ল্যাবে তৈরি ভাইরাসের নমুনাসহ সবই ধ্বংস হয়ে গেছে।

ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, গবেষণার স্থানটি ছিল আমার দ্বিতীয় বাড়ি। গত ২২ বছর ধরে আমি এখানে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যেই আগুন সেটিকে ধ্বংস করে ফেলেছে। ভবনের তিনটি তলা পুরোপুরি ধসে গেছে। কিছুই অবশিষ্ট নেই।

ইনস্টিটিউটজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ৪৫টি ল্যাব ধ্বংস হয়েছে এবং এতে প্রায় ৪০০–৫০০ গবেষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ল্যাবগুলোর মধ্যে জীবনবিজ্ঞান, অণুজীববিজ্ঞান ও স্নায়ুবিজ্ঞানের ল্যাবও ছিল, যেখানে অপরিবর্তনীয় টিস্যু স্লাইড ও সেল লাইন নষ্ট হয়েছে।

প্ল্যানেটারি সায়েন্সেস ভবন—যেখানে ভূ-রসায়ন ও অন্যান্য গবেষণা চলত, সরাসরি আঘাতে নয় বরং পার্শ্ববর্তী রসায়ন ভবনে আঘাত করা ক্ষেপণাস্ত্রের শকওয়েভে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

প্রেস টিভি বলছে—ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইনস্টিটিউটের প্রায় ৯০ শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর্থিক ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ৩০০–৫৭০ মিলিয়ন ডলার।

সামরিক-সংশ্লিষ্টতা

ভাইসমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স যে সামরিক গবেষণার সঙ্গে জড়িত তা কখনও প্রকাশ্যে আনা হয়নি। এর অনেক গবেষণা প্রতিবেদন একাডেমিক জার্নালে প্রকাশিত হয়। ইসরায়েলি ও পশ্চিমা মিডিয়া প্রায়শই এই ইনস্টিটিউটের মৌলিক ও প্রায়োগিক বিজ্ঞানের অর্জনগুলোকে তুলে ধরে, সামরিক-সংশ্লিষ্টতাকে হালকা করে দেখায়।

আরও পড়ুনঃ  ভারত সমর্থিত ৩০ সন্ত্রাসী নিহত

তবে ভাইসমান ইনস্টিটিউট ‘এলবিত সিস্টেমস’র মতো সামরিক ঠিকাদারদের সঙ্গে যৌথভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ড্রোন প্রযুক্তি, দ্বৈত-ব্যবহার্য সামগ্রী উদ্ভাবন ও পারমাণবিক গবেষণার মধ্য দিয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে স্পষ্ট ও নথিভুক্ত সংযোগ বজায় রেখে চলে।

ইনস্টিটিউটটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ড্রোন প্রযুক্তি, সাইবার সিকিউরিটি, ভৌত বিজ্ঞান, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, স্বায়ত্তশাসিত সিস্টেম, ইলেকট্রনিক ট্র‌্যাকিং ও জ্যামিং এবং বিকল্প জিপিএস নেভিগেশনসহ ইসরায়েলি সামরিক সক্ষমতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ইনস্টিটিউটের স্নাতকরা প্রায়শই অভিজাত সামরিক শাখা ‘ইউনিট ৮২০০’ ও ‘তালপিয়ট প্রোগ্রাম’-এ যোগ দেন। তারা ইসরায়েলের শীর্ষ সিগন্যাল ও সাইবার যুদ্ধ বিভাগ এবং বৈজ্ঞানিক ও সামরিক বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণ দেয়।

অধ্যাপক ইরান সেগালের ল্যাবের মতো আরও কয়েকটি ল্যাবকে গাজা ও ইরানসহ ইসরায়েলি আগ্রাসনের সময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তাৎক্ষণিক নজরদারির জন্য অ্যালগরিদমিক সিস্টেম উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

১৯৪৮ সালে নাকবা’র সময় ভাইসমান ইনস্টিটিউটের যন্ত্রপাতি ও ক্যাম্পাস সরঞ্জামাদি সরাসরি জায়নিস্ট প্যারামিলিটারি দল হাগানাহ’র কাজে ব্যবহার করা হয়েছিল। পরে নতুনভাবে গঠিত ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাজেও তা ব্যবহৃত হয়।

ইনস্টিটিউটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও প্লাস্টিক বিস্ফোরক, রকেট, মর্টার ও কামান শেল, ন্যাপালম, টিয়ার গ্যাস ও মাইনসহ নানা ধরনের সমরাস্ত্র তৈরিতে যুক্ত।

নাকবা’র শেষের দিকে এই ইনস্টিটিউট সামরিক বিজ্ঞান দলের মূল ভিত্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং টেকনিয়নকে সঙ্গে নিয়ে ইসরায়েলি শাসন ব্যবস্থার প্রধান সামরিক ও বৈজ্ঞানিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

গাজায় ইসরায়েলি সেনা নিহত, কারণ জানালো আইডিএফ
উভয় প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ প্রশাসক ও শিক্ষকরা ইসরায়েলের সামরিক-শিল্প কমপ্লেক্স গঠনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তারা ইসরায়েলি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সামরিক শক্তির ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ধারণাকে সমর্থন করেন, দেশীয় উন্নয়ন ও উন্নত অস্ত্র তৈরির জন্য চাপ দেন। এর ফলে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে ইসরায়েলি সামরিক নেতৃত্বের প্রায়শই বিরোধ হতো।

আরও পড়ুনঃ  যেভাবে মৃত্যু হয় জোটা ও তার ভাইয়ের

শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীদেরই জয় হয়। তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব প্রতিষ্ঠা পায়। সামরিক বিজ্ঞান বিভাগ সামরিক কমান্ড থেকে আলাদা হয়ে গবেষণা ও ডিজাইন দপ্তরের রূপ নেয়। এতে নেতৃত্ব দেন ভাইসমান ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রশাসক আর্নস্ট ডেভিড বার্গম্যান।

ইসরায়েলের পরমাণু প্রকল্পের মাস্টারমাইন্ড

ভাইসমান ইনস্টিটিউট দীর্ঘ সময় ধরে ইসরায়েলের গোপন পারমাণবিক প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত। কেননা, ১৯৫২ সালে গঠিত ইসরায়েলের পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন আর্নস্ট ডেভিড বার্গম্যান।
১৯৫০-এর দশকে এই ইনস্টিটিউট নেগেভ মরুভূমি থেকে ইউরেনিয়াম উত্তোলনের কাজে অবদান রাখে।

অনেক বিজ্ঞানী ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্র প্রকল্পের মূল কেন্দ্র শিমন পেরেস নেগেভ নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টারে (ডিমোনা) কাজ করেছেন। তারা ভাইসমান ইনস্টিটিউটের স্নাতক কিংবা শিক্ষক ছিলেন।

এফবিআই’র তদন্তেও উঠে আসে—ভাইসমান ইনস্টিটিউট পারমাণবিক ও প্রচলিত অস্ত্র উন্নয়নে গবেষণার পাশাপাশি গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সিস্টেমেও প্রবেশ করেছে।

কয়েক দশক ধরে ইসরায়েলি গণমাধ্যম ও কর্মকর্তারা ভাইসমান ইনস্টিটিউটকে তাদের ‘প্রযুক্তির মেরুদণ্ড’ ও ‘বৈজ্ঞানিক ও সামরিক মস্তিষ্ক’ হিসেবে উল্লেখ করে আসছে। এসব তকমা প্রতিষ্ঠানটির কৌশলগত গুরুত্বকে তুলে ধরে। কিন্তু ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় সুর পাল্টে ফেলেছে ইসরায়েলি গণমাধ্যম ও কর্মকর্তারা। তারা এখন ভাইসমান ইনস্টিটিউটকে একটি ‘সাদামাটা’ বেসামরিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করছে।

সূত্র: প্রেস টিভি

আপনার মতামত লিখুনঃ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ