Tuesday, July 8, 2025

কক্ষপথে রাশিয়ার ‘অস্ত্রবাহী’ স্যাটেলাইট, বিশ্বের জন্য ভয়ানক বার্তা

আরও পড়ুন

মহাকাশ যেন আর কেবল গবেষণা কিংবা উপগ্রহ যোগাযোগের ক্ষেত্র নয়—বরং হয়ে উঠছে পরাশক্তিদের নতুন সামরিক প্রতিযোগিতার মঞ্চ। সম্প্রতি রাশিয়ার ‘মাত্রিওশকা স্যাটেলাইট’ কর্মসূচি নিয়ে বিশ্বজুড়ে বেড়েছে উদ্বেগ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট রাশিয়ার এই ক্রমবর্ধমান স্যাটেলাইট কর্মসূচিকে অন্যতম হুমকি হিসেবে দেখছে।

ইউরেশিয়ান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুশ লোককথার কাঠের পুতুলের মতো, যেগুলোর একটির ভেতরে আরেকটি লুকানো থাকে, ঠিক সেই কৌশলেই রাশিয়া তৈরি করেছে বহুস্তর বিশিষ্ট স্যাটেলাইট, যেগুলো ‘মাতৃস্যাটেলাইট’ নামে পরিচিত। এসব স্যাটেলাইট কক্ষপথে গিয়ে নির্দিষ্ট সময় বা লক্ষ্য অনুযায়ী ছোট সাবস্যাটেলাইট বা গোপন বস্তু মুক্ত করে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে নজরদারি, অনুসরণ এবং এমনকি ধ্বংসাত্মক আঘাত হানার সামর্থ্য।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়ার এই ‘মাতৃ স্যাটেলাইট’ থেকে বেরিয়ে আসা ছোট ‘সাবস্যাটেলাইট’ বা ‘অবজেক্ট – সি’গুলো শুধু নজরদারির জন্য নয়, সেগুলোর মধ্যে কিছুতে থাকতে পারে অ্যান্টি-স্যাটেলাইট (এএসএটি) অস্ত্র। মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, এগুলোর মাধ্যমে রাশিয়া চাইলেই গোপনে প্রতিপক্ষের স্যাটেলাইটকে অকার্যকর করে দিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর স্যাটেলাইটকে অনুসরণ করছে রুশ স্যাটেলাইট

২০২২ সালে স্পেসএক্সের ফ্যালকন-৯ রকেটের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হয় ইউএএসএ-৩২৬ নামের একটি মার্কিন গুপ্তচর স্যাটেলাইট। এর মিশন অত্যন্ত গোপনীয় হলেও ধারণা করা হয় এটি কেএইচ-১১ সিরিজের উন্নত রিকনেসান্স স্যাটেলাইট, যা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে রিয়েল-টাইম হাই-রেজুলুশন ছবি পাঠাতে সক্ষম।

আরও পড়ুনঃ  ইরানি হামলায় ৫ সামরিক ঘাঁটি ধ্বংস: ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতির গোপন তথ্য ফাঁস!

এই স্যাটেলাইটটির পেছনেই গত তিন বছর ধরে নীরবে ছায়ার মতো লেগে ছিল রাশিয়ার ‘কসমস-২৫৫৮’, যেটি গত ২৮ জুন হঠাৎ করেই কক্ষপথে ‘অবজেক্ট – সি’ নামক একটি রহস্যজনক বস্তু নির্গত করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি হতে পারে একটি আক্রমণাত্মক সাবস্যাটেলাইট।

এই অস্বাভাবিক কৌশলকে বিশ্লেষকরা বলছেন ‘স্পেস স্টকিং’ বা মহাকাশে গুপ্ত নজরদারি। আর এই স্যাটেলাইটগুলোকে ডাকা হচ্ছে ‘মাতৃস্যাটেলাইট’ বা ‘মহাকাশের গুপ্ত ঘাতক’ নামে।

প্রকল্প ‘নিভেলির’ : রাশিয়ার মহাকাশে গোপন অস্ত্রায়নের নীলনকশা

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, রাশিয়ার এই কর্মকাণ্ড হঠাৎ শুরু হয়নি। বরং এটি ‘প্রজেক্ট নিভেলির’ নামের একটি বহু বছরের গোপন সামরিক প্রকল্পের অংশ, যা শুরু হয় ২০১১ সালে। ডাচ গবেষক ও স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং বিশেষজ্ঞ মার্কো ল্যাংব্রুক এবং রুশ মহাকাশ বিশ্লেষক বার্ট হেনড্রিক্স জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের অধীনে রাশিয়া ইতোমধ্যেই অন্তত তিনবার এই ধরনের স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে, যেগুলো পরে ছোট অস্ত্রবাহী বস্তু নির্গত করেছে।

আরও পড়ুনঃ  আবারো ভারতে শেখ হাসিনার সঙ্গে আ.লীগ নেতাদের বৈঠকের খবর নিয়ে যা জানা যাচ্ছে

এই সাবস্যাটেলাইটগুলো অনেক সময় রাশিয়ার নিজস্ব স্যাটেলাইটেই হামলার মহড়া চালায়, যেন আন্তর্জাতিক তদন্ত এড়ানো যায়। কখনো এগুলো দ্রুত কক্ষপথ বদলে বা প্রজেক্টাইল নিক্ষেপ করে যুদ্ধের অনুশীলন চালায়।

রাশিয়া কি মহাকাশে পারমাণবিক অস্ত্র প্রস্তুত করছে?

২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে এক সাক্ষাৎকারে ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটে প্রকাশ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন—মস্কো সম্ভবত মহাকাশে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের পরিকল্পনা করছে। এমন ঘটনা ঘটলে তা হবে আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘন এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য চরম হুমকি।

তিনি বলেন, ‘যদি কোনোদিন স্যাটেলাইটের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়, তাহলে তা গোটা বিশ্বের যোগাযোগ, ন্যাভিগেশন ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অচল করে দিতে পারে।’

অতীতের ছায়া : কসমস স্যাটেলাইটের রহস্যময় ইতিহাস

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ ও ২০১৫ সালে ‘কসমস-২৪৯১’ ও ‘কসমস-২৪৯৯’ নামের দুটি রুশ স্যাটেলাইট রহস্যজনকভাবে ভেঙে পড়ে। সম্ভবত মহাকাশে অস্ত্র পরীক্ষার ফলেই এগুলো ধ্বংস হয়েছিল।

২০১৭ সালে ‘কসমস-২৫১৯’ স্যাটেলাইট থেকে ‘কসমস-২৫২১’ নামের আরেকটি স্যাটেলাইট অবমুক্ত হয়, এবং এর মধ্য থেকেও ‘কসমস-২৫২৩’ নামের তৃতীয় আরেকটি স্যাটেলাইট বের হয়ে আসে। তৃতীয় এই স্যাটেলাইটটি আচমকা কক্ষপথ বদলে বিস্ময় সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুনঃ  জানা গেলো যে কারণে কাতারে প্রতিনিধিদল পাঠাচ্ছে ইসরায়েল

২০২০ সারে কসমস-২৫৪৩ একটি গোপন প্রজেক্টাইল ছুড়ে দেয় কসমস-২৫৩৫-এর দিকে, যেটি ছিল নিবন্ধনহীন এবং আন্তর্জাতিক নিয়মের লঙ্ঘন।

কারা চালাচ্ছে এই ভয়ংকর প্রকল্প?

নিভিলার (Nivelir) প্রকল্প পরিচালনার মূল দায়িত্বে রয়েছে মস্কো ভিত্তিক TsNIIKhM (Central Scientific Research Institute of Chemistry and Mechanics)। এটি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ২০১১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি করে।

প্ল্যাটফর্ম ও স্যাটেলাইট বানানোর দায়িত্বে রয়েছে NPO Lavochkin, আর TsNIIKhM তৈরি করছে ক্ষেপণাস্ত্রধর্মী গোপন পে-লোড ও পরীক্ষামূলক অস্ত্র।

বিশ্ব কি একটি নীরব মহাকাশ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে?

ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন মতে, রাশিয়ার এই ‘মাতৃস্যাটেলাইট’ কৌশল শুধুই নজরদারি নয়, বরং মহাকাশকে পরিণত করছে সম্ভাব্য যুদ্ধক্ষেত্রে। যেখানে লড়াই হবে না কোনো গোলাগুলিতে, বরং হবে নিঃশব্দে—কক্ষপথ বদলের মধ্য দিয়ে, কিংবা এক মুহূর্তে নিস্তব্ধ হয়ে যাওয়া কোনো উপগ্রহের মাধ্যমে।

বিশ্ব যত বেশি স্যাটেলাইট-নির্ভর হয়ে পড়ছে, ততই এই ছায়াযুদ্ধের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আর রাশিয়ার ‘নিভেলির’ প্রকল্প সেই যুদ্ধকে আরেক ধাপে এগিয়ে নিচ্ছে—নির্বাক, অদৃশ্য, কিন্তু অত্যন্ত ভয়ানক।

আপনার মতামত লিখুনঃ

আরও পড়ুন

সর্বশেষ সংবাদ