অস্থির সময় যাচ্ছে। রাজনীতিতে দিন দিন বিভাজন স্পষ্ট হচ্ছে। এমন সব বক্তব্য কেউ কেউ দিচ্ছেন যা খুবই বেমানান। বলতে গেলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান। এমন পরিস্থিতিতে আজ লিখতে বসেছি আপা আপনাকে। আপনি ভিন দেশ থেকে সব খবরই পাচ্ছেন। এসব নিয়ে আবার দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে টেলিকথন করে যাচ্ছেন। এতে আপা খুশি হওয়ার কিছু নেই। আপনার কোনো লাভ হবে না। অবশ্য আপনি লাভ হবে ভেবে আপনার বক্তব্যে নেতাকর্মীদের উস্কে দেয়ার ভাষা শোনা যায়। যা আরও বিপদ ডেকে আনছে। আগেই বলেছিলাম, এখন উস্কে দেয়ার সময় নয়। মাথা ঠাণ্ডা রেখে এগিয়ে যাওয়ার সময়।
প্রিয়, হাসু আপা-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনার তেজোদ্দীপ্ত কথা শুনে সান্ত্বনা পাই যে, আপনি খুবই ভালো আছেন। আপনার এই তেজ নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করবে। এটা হয়তো ভাবছেন। কিন্তু দেশে এমন তেজ এখনো দেখা যায়নি। মাঝে মাঝে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হঠাৎ হঠাৎ দুয়েকজন এসে কিছু কথা বলেন। আর আপনি সরকারে থাকতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের যেসব মিছিল হয়েছিল তার অংশবিশেষ কেটে তা ফেসবুকে এখন বলে চালানো হচ্ছে। তবে ইদানীং কোথাও কোথাও আপনার নেতাকর্মীরা নড়েচড়ে বসেছে বলে মনে হয়। তবে এতে কতোটুকু লাভ হবে আপনার কিংবা আপনার দলের আল্লাহ মালুম।
আপা, আপাগো আপনার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শুরু হয়েছে। আপনার নিয়োগ দেয়া পুলিশ প্রধান রাজসাক্ষী হিসেবে আপনার আমলনামা আদালতে হাজির করছেন। আচ্ছা আপা, এমন মানুষদের আপনি আপন ভেবেছিলেন। আপনার কি মনে ছিল না জেনারেল মইনুদ্দীনকে বেগম খালেদা জিয়া নিয়োগ দিয়েছিলেন। সেই মইনুদ্দীনের কি ভূমিকা ছিল খালেদার পরিবারের বিরুদ্ধে। আসলে আপনারা রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় গেলে সব ভুলে যান। কেউ একটু তেল দিয়ে কথা বললে তাকে আপন মনে করেন। নিজের বিবেক বুদ্ধি তখন চাপা পড়ে যায় সেই তেলের কাছে। আর আপনিই করবেন কি? কেউ কেউ তো দূর দেশ থেকে সুগন্ধি তেল নিয়ে হাজির হয়। যার গন্ধে আপনার মতো ক্ষমতাধররা মাতোয়ারা হয়ে উঠেন। কখনো কখনো তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। আপনার কথাতো আলাদা। বাংলাদেশটা আপনার বাবার দেশ। দেশের আঠার কোটি মানুষকে আপনি খাইয়েছেন। সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিয়েছেন। আপনার পা ছুঁয়ে যিনি সালাম করতো তাকে প্রেসিডেন্ট বানিয়েছেন। আপনার দলের জাঁদরেল নেতাদের যে শিক্ষা দিয়েছেন তা শুধুমাত্র আপনার দ্বারাই সম্ভব ছিল। আরও কতো কিছু করেছেন। মাঝে মাঝে পুকুরে মাছ ধরে মজা করেছেন। সমুদ্রের পাড়ে খালি পায়ে হেঁটে দেশবাসীকে চমকে দিয়েছেন। আবার নিজে রান্না করে সেই ফটো তুলিয়ে মিডিয়ায় প্রচার করিয়েছেন। তখনই আপনার বহু পুরনো একটি সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ে- যেখানে আপনি বলেছিলেন- আমি ক্ষমতায় গেলে বিটিভিতে সপ্তাহে একদিনের বেশি দেখা যাবে না। কিন্তু আমরা কী দেখলাম। সবক’টি টিভির প্রধান শিরোনাম হতো আপনাকে নিয়ে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় আপনার বক্তব্য শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিল দেশবাসীর। গত একবছর টিভি মিডিয়ায় আপনার কথা আর শুনতে হয় না। দেশবাসী মনে হয় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। কেন যে আপনি এত কথা বলতে যান? কী লাভ হলো? সংসদে দাঁড়িয়ে বললেন-আওয়ামী লীগ পালায় না। হাসিনা পালায় না। জোর দিয়ে আরও কতো কি বললেন। কিন্তু জাতি কি দেখলো? আপনি আপনার দলের নেতাকর্মীদের অরক্ষিত রেখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। অবশ্য নির্বাচনের আগে আগে আপনার দলের সেক্রেটারি জোর দিয়ে বলতেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না এলে একদিনেই লাখো মানুষ মারা যাবে। তার এ কথায় স্পষ্ট আপনারা যে অন্যায়- অবিচার করেছেন দেশবাসীর ওপর- তা দেশবাসী কখনোই ভুলবে না। তারা প্রতিশোধ নেবে। ক্ষমতা হারানোমাত্রই আপনার দলের লাখো নেতাকর্মী তাদের কৃতকর্মের জন্য দেশবাসীর রোষানলে পড়বে। কিন্তু কি দেখলেন আপা? আওয়ামী লীগ অন্যায় অবিচার করতে পারে। দেশবাসী কখনোই অন্যায় অবিচার করে না। তারা কোনো প্রতিশোধ নেয়নি। প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টাও করেনি। তাই তো আপনার দলের নেতাকর্মীরা এখনো সমাজে সবার সঙ্গে বসবাস করছে। যারা পালিয়ে গেছে তাদের অপরাধের বোঝা দেশের মাটি সইতে পারেনি। তাই এ মাটি তাদের গ্রহণ করেনি। আপা, কথায় বলে-আল্লার মাইর দুনিয়ার বাইর। সত্যিই আপনার আমলের প্রায় ষোল বছরের জুলুম, অত্যাচার, গুম, হত্যা, নিপীড়ন, নির্যাতন, মামলা, হামলা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, প্রকৃতি তা সহ্য করতে পারেনি। তাই প্রকৃতির বিচার দেখেছে দেশবাসী।
হাসু আপা, আজও ফেসবুকে দেখলাম, ভিনদেশে বসে আপনার নেতাকর্মীরা দেশে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরির চেষ্টা করছে। এজন্য নানা প্ল্যান সাজানো হয়েছে। প্ল্যান-১, প্ল্যান-২, প্ল্যান-৩ -এভাবে সাজানো হয়েছে। এখন বাস্তবায়নের পালা। আপা এসব প্ল্যান করে কি দেশের মানুষের মন জয় করতে পারবেন? বরং হিতে বিপরীত হবে। এসব না করে এমন কাজ করুন যা দেখে দেশবাসীর আপনার প্রতি প্রেম জন্মায়। ভালোবাসা জন্মায়। আবেগ জন্মায়। তারাই দাবি তুলে বলবে হাসিনাকে বাংলাদেশে চাই। রাজনীতিতে চাই। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চাই। কিন্তু আপনার ও আপনার দলের লোকজনের কর্মকাণ্ড দেখে তো মনে হয় না আপনারা এটা চান। আপনারা চান দেশকে অস্থিতিশীল করে ঢুকে পড়তে। সেইদিন কি আছে আপা? সেই দিন আর নেই। এখন দিন বদলেছে। আপনি ক্ষমতায় নেই। ক্ষমতার স্বাদ আপনার কাছ থেকে দূরে চলে গেছে। আপনি এখন ক্ষমতাহীন মানুষ। মানে দন্তহীন বাঘ। এ জিনিসটা মনে রেখে এগিয়ে যান দেখবেন আবার নতুন করে দন্ত গজাবে। আবার কামড় বসাতে পারবেন।
হাসু আপা, এত এত অপরাধ করেও একবারও কি আপনার মনে অনুশোচনা জাগে না? একবারও কি মনে চায় না দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার। ক্ষমা চাওয়াতে তো লজ্জা নেই। বরং নিজে বড় হওয়া যায়। যে দেশটাকে নিজের বাবার সম্পত্তি ভাবতেন, সেটা যে আপনার বাবার একার সম্পত্তি নয় সেটা তো এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন আপা। এ দেশটা সকলের। সব মানুষের। ধনী-গরিব, চাষাভুসা, চাকর-বাকর, নেতানেত্রী সকলের। কিন্তু আপনি নিজেকে রাজা ভেবে সকলকে আশ্রিত মনে করেছেন। মানুষকে মানুষ মনে করেননি। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছেন। ফকির ভেবেছেন। এসবই ছিল আপনার ভুল। কেন গো আপা, এমনটা কেন করলেন? দেশবাসী ভোট দিয়ে ২০০৮ সালে আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল এসব করার জন্য? দেশটাকে নরকপুরী বানানোর জন্য। এখন বিশ্ব মিডিয়া আপনাকে নিষ্ঠুরতম স্বৈরাচার হিসেবে উপাধি দিয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা আপনার আমলের আয়নাঘরসহ যতসব অপকীর্তি সব বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরছে। এসব যখন দেখি খুব লজ্জা পাই আপা। আর বলি-আপা নিজে তো দেশ ছাড়লোই বিশ্বে দেশের মানকে ধুলোয় মিশিয়ে গেল। তাই বলছি আপা, আর আপনার নেতাকর্মীদের না উস্কিয়ে তাদের বলুন যা ভুল হয়েছে আর যেন কোনো ভুল তাদের দ্বারা না হয়। এখন মানুষের কাছে গিয়ে যেন নিজেদের সকল ভুলের জন্য ক্ষমা চান।
আপা, আপনি একবার ভেবে দেখেছেন আপনার কর্মকাণ্ডের জন্য দেশের স্থপতি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কতো অপমানিত হয়েছেন। আপনি পালানোর পর মোড়ে মোড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের উপর যে হামলা হয়েছে এর জন্য দেশবাসী আপনাকে দায়ী করছে। ক্ষমতায় থাকতে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করেছেন যে, তাকে নিচে নামাতে নামাতে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষ হাজার বছরেও কোনো দেশে জন্মায় না। আর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষ হাজার বছরেও জন্মাবে না। এমন মানুষকে কেন কলঙ্কিত করলেন আপনি। আপনার পিতা হতে পারেন- তিনি তো দেশের সম্পদ। এ কথাটি একবারও ভাবলেন না। আপনার কারণে তিনি দেশের সম্পদ হতে পারেননি। তিনি হয়েছেন আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পদ। যাকে বিক্রি করে আওয়ামী লীগ ভবিষ্যৎ এগিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু পারেনি। কারণ এখানেও ছিল বিরাট গলদ। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যবসা করে এগিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ এখন কী নিয়ে এগুবে? ভেবেছেন কি? নাকি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উপর ভর করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন? তবে আর যাই করুন-ষড়যন্ত্র আর করবেন না। দেশটাকে নিয়ে অনেক খেলেছেন। আর নয়। দেশের মানুষ আর ফুটবল হতে চায় না। তারা চায় খেলোয়াড় হতে। আপনার আমলের পুরো সময় যাদের ফুটবল বানিয়ে রেখেছিলেন। রাতে ভোট চুরি করে পরদিন রেজাল্ট দেয়া হয়। আর আপনি খুশিতে গদগদ হয়ে টিভিতে এসে বললেন-জনগণ আমাদের উপর আস্থা রেখেছে। আবারো আমাদের দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। সব জেনে শুনে এমন সত্য কথা কি করে বলেন? বঙ্গবন্ধুর মেয়ের মুখে এমন সত্য মানায় না। এটা খুবই বেমানান। একদিনে মানুষ আপনার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। ষোল বছরে এমন বহু ঘটনা আপনাকে আমজনতা থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। আর আপনার চেলা-চামুণ্ডারা বলেছে, আপা সব ঠিক আছে। সব পানির মতো সোজা। এগিয়ে যান আপা। বিএনপি-জামায়াত মরে গেছে। ওদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে। এ কথা শুনে আপনিও নানা ভাষণে বলতেন- এদেশে আর বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসতে পারবে না। জনগণ মনে মনে তখন বলতো, আসবে কি করে-নির্বাচন ব্যবস্থা ওলটপালট করে এমন করা হয়েছে-যাতে নির্বাচন হলেই আপনি ও আপনার দল ক্ষমতায় আসেন। পৃথিবীতে আপনি বিশ্বরেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি। কোথা থেকে পিচ্ছিরা এসে কোটা দাবি নিয়ে মাঠে নামলো। আপনি গোলকধাঁধায় পড়ে গেলেন। গিয়ে পড়লেন পাশের দেশ ভারতে।