ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বন্দি বিনিময় চুক্তির দাবিতে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবে বিক্ষোভ করেছেন হাজারো মানুষ। শনিবার (১৩ জুলাই) রাতে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ থেকে, যুদ্ধ থামিয়ে গাজায় আটক ইসরায়েলি বন্দিদের ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তারা।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম চ্যানেল ১৩ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা “বন্দিদের ছাড়া কোনো বিজয় নয়” এবং “গাজায় ৫০টি পরিবার এখনো বন্দি”—এমন স্লোগান লেখা ব্যানার হাতে নিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন। বিক্ষোভের ফলে দেশের অভ্যন্তরে নেতানিয়াহু সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি হচ্ছে।
এই বিক্ষোভ এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন কাতারে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনায় অচলাবস্থা বিরাজ করছে। তবে ইসরায়েলের এক রাজনৈতিক কর্মকর্তা চ্যানেল ১৩ কে জানিয়েছেন, “আলোচনা ভেঙে পড়েনি। হামাসের একগুঁয়েমির মধ্যেও ইসরায়েলি প্রতিনিধিরা এখনো দোহায় আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন।”
গাজায় আটকে থাকা ইসরায়েলি বন্দিদের পরিবারের একটি ফোরাম সরকারকে যুদ্ধ বন্ধ করার এবং বন্দি বিনিময় চুক্তি করার আহ্বান জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, “বর্তমান সুযোগ হাতছাড়া হওয়া একটি ভয়াবহ ব্যর্থতা হবে। প্রতিটি দিন হামাসের জন্য একটি অর্জন এবং আমাদের বন্দি ও সেনাদের জন্য চরম ঝুঁকি।”
তারা আরও জানিয়েছে, “সব জরিপ ও তথ্য বলছে, ইসরায়েলি জনগণের একটি সুস্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ গাজা যুদ্ধের অবসান ও বন্দিদের ফেরত চায়, এমনকি ক্ষমতাসীন জোটের ভোটারদের মধ্যেও এটি পরিষ্কারভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।”
এই ফোরাম ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর উদ্দেশ্যে বার্তা দিয়ে বলেছে, “ইতিহাস মনে রাখবে আপনি কী বেছে নিলেন—বন্দি ও যোদ্ধাদের, না আপনার রাজনৈতিক সুবিধা।”
হামাসের প্রস্তাব ও ইসরায়েলের ‘অনমনীয়তা’
এর আগে গত বুধবার হামাস জানায়, তারা গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের লক্ষ্যে হিসেবে ১০ জন জীবিত ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দিতে সম্মত হয়েছে। তবে হামাসের দাবি, ইসরায়েল এখনো মূল কয়েকটি বিষয়ে অনড় রয়েছে।
এই ‘মূল বিষয়গুলোর’ মধ্যে রয়েছে, রাফাহ সীমান্তে ২-৩ কিলোমিটার চওড়া একটি বাফার জোন গঠন এবং গাজার অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলে ১-২ কিলোমিটার চওড়া নিয়ন্ত্রণ এলাকা নির্ধারণ করা। হামাসের দাবি, এইসব বিষয়ে একমত না হওয়ার কারণে একটি পূর্ণ যুদ্ধবিরতির চুক্তি এগিয়ে যেতে পারছে না।
আন্তর্জাতিক চাপ ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ
এদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও ইসরায়েল গাজায় ভয়াবহ হামলা অব্যাহত রেখেছে। এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি আক্রমণে প্রায় ৫৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। এসব হামলায় গাজার বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। খাদ্য সংকট, অপুষ্টি এবং মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো অঞ্চলজুড়ে।
গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োয়াভ গালান্টের বিরুদ্ধে গাজায় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এছাড়া গাজায় গণহত্যার অভিযোগে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি গণহত্যা মামলা এখন চলছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে)।
এই বিক্ষোভ এবং হামাস-ইসরায়েল আলোচনায় অচলাবস্থা—দুইই ইঙ্গিত দিচ্ছে গাজা যুদ্ধ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পৌঁছেছে। ইসরায়েলি সমাজে যুদ্ধবিরতির দাবি ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। ফিলিস্তিনি পক্ষ থেকেও আংশিক ছাড় দিয়ে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। তবে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকারের কঠোর রাজনৈতিক অবস্থান ও আভ্যন্তরীণ চাপের কারণে বাস্তব অগ্রগতি অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে এটি শুধু বন্দিদের জীবনকেই বিপন্ন করছে না, বরং ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক অবস্থানকেও আরও দুর্বল করছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, আইসিসি’র পরোয়ানা এবং আইসিজে’র বিচারিক প্রক্রিয়া নেতানিয়াহুর সরকারকে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পারে।
সূত্র : আনাদুলু