‘ও বাবু, আমার সোনামনি কই? ওরে মাগো, আমার সোনামনি কই?’—এভাবেই আর্তনাদ করছিলেন রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সায়ান ইউসুফের (১৪) দাদি কামরুন নাহার।
বাবা এএফএম ইউসুফ বলছিলেন, “আমিতো কারও ক্ষতি করি নাই। আমার ছেলে মেধাবী ছিল। ক্লাসে সে প্রথম হতো। এতো সুন্দর, এতো স্মার্ট ছিল! আমার ছেলেরে আমি সবসময় ‘আইনস্টাইন’ বলে ডাকতাম। আমার সঙ্গে কেন এমন হলো?’
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) দুপুর সোয়া ১২ টার দিকে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের বশিকপুর গ্রামের পাল বাড়িতে গেলে তাদের এমন আর্তনাদ করতে দেখা যায়। তখনো সায়ানের মরদেহ বাড়িতে আসেনি।
দুপুর পৌনে ১টার দিকে সায়ানের লাশবাহী গাড়ি বাড়ির সামনে আসে। গাড়ি শব্দ শুনেই কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসছিলেন দাদি কামরুন নাহার। এসময় কয়েকজন তাকে ধরে রাখেন। এরপর তিনি তাদের ভেদ করে লাশবাহী গাড়ির কাছে ছুটে যেতে চান। সবাই তাকে বুঝিয়ে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেও কান্না থামেনি তার।
সায়ানের লাশবাহী গাড়ি বাড়িতে আসার ১০ মিনিট পর অন্য একটি গাড়িতে তার বাবা মাইলস্টোন কলেজ শাখার রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এএফএম ইউসুফও আসেন। গাড়ি থেকে নামতেই বন্ধু ও স্বজনদের জড়িয়ে কাতর হয়ে ওঠেন তিনি। আর সবাইকে বলছিলেন, ‘আমি তো কারও ক্ষতি করি নাই। আমার সঙ্গে কেন এমন হলো?’
ছেলেরে ‘আইনস্টাইন’ বলে ডাকতাম, আমার সঙ্গে কেন এমন হলো?’
সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান রাজধানীর উত্তরায় দুর্ঘটনায় পড়ে। বিমানটি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনে গিয়ে পড়ে এবং বিধ্বস্ত হয়। সঙ্গে সঙ্গে বিমান ও স্কুল ভবনটিতে আগুন ধরে যায়। যে ভবনে এটি বিধ্বস্ত হয়, সেখানে বহু শিক্ষার্থী ছিল। যাদের বেশিরভাগই হতাহত হয়েছে।
নিহত সায়ানের চাচা মিজানুর রহমান বলেন, ‘ঝলসানো শরীর ও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে সায়ান ঘটনাস্থল থেকে নিজেই বের হয়ে আসে। পরে তার বাবা-মা শনাক্ত করে। সেই প্রথম বের হয়ে এসেছে ভিডিওতে দেখেছি। সোমবার দিনগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়।’
তিনি আরও জানান, বিকেল ৩টার দিকে জানাজা শেষে দাদা ডা. মাকসুদুর রহমানের কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে সায়ানকে।
সায়ানের বাবার বন্ধু মো. দিদার জানান, ইউসুফের এক ছেলে ও এক মেয়ে। সায়ান অত্যন্ত মেধাবী ছিল। তার বাবার স্বপ্ন ছিল তাকে আমেরিকায় পড়ালেখা করাবে। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনায় তার ছেলেটি মারা গেছে।
নিহত সায়ান লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নের বশিকপুর গ্রামের পাল বাড়ির সন্তান। তার বাবা এএফএম ইউসুফ মাইলস্টোন কলেজ শাখার রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও মা শামীমা শাম্মী মাইলস্টোন স্কুল শাখার রসায়নের শিক্ষক। তার একমাত্র বোন ফারিশা মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। তারা উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে ভাড়া থাকতেন বলে জানা গেছে।
সবশেষ ঈদুল আজহার ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা ও বোনের সঙ্গে ঈদ করতে আসে সায়ান। আবারও কোনো এক ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে আসার কথা ছিল। কিন্তু লাশ হয়ে সে একেবারেই চলে এসেছে। তার মৃত্যুতে পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের মাঝে শোকের মাতম চলছে।
একই ঘটনায় সদর উপজেলার পার্বতীনগর ইউনিয়ন সোনাপুর গ্রামের রহিমবক্স হাজি বাড়ির আব্দুস সামাদের ছেলে আফনান ফায়াজও মারা যায়। তাকে সকালে ঢাকায় দাফন করা হয়েছে বলে পরিবার সূত্রে জানা গেছে। আফনানও সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল।