গত মে মাসে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতের ফলে রাফাল যুদ্ধবিমানের কার্যকারিতা নিয়ে বেশ চাপে পড়েছে ফ্রান্স। এ অবস্থায় কৌশলে এর সুযোগ নিচ্ছে চীন। ফ্রান্সের সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, রাফাল যুদ্ধবিমানের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ ছড়িয়ে দিতে চীন তাদের দূতাবাসগুলো ব্যবহার করছে। খবর আল জাজিরা
ফ্রান্স কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ফরাসি বার্তা সংস্থা এপি রোববার (৬ জুলাই) জানিয়েছে, ফ্রান্সের তৈরি ফ্ল্যাগশিপ যুদ্ধবিমানের বিক্রি কমাতে এর দুর্বলতা এবং খ্যাতির বিরুদ্ধে কাজ করছে চীন।
ফরাসি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনা দূতাবাসগুলো রাফাল যুদ্ধবিমান বিক্রি বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে যেসব দেশ রাফাল যুদ্ধবিমার অর্ডার করেছে বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া, তাকে রাফাল না কেনার জন্য এবং এর পরিবর্তে চীনের তৈরি যুদ্ধবিমান ক্রয় করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
এপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্রান্সের সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে এই তথ্যগুলো জানিয়েছেন।
গত কয়েক বছরের মধ্যে মে মাসে ভারত ও পাকিস্তান চারদিনের সংঘাতে ছড়িয়ে পড়ে। পরমাণু শক্তিধর দেশ দুটি আকাশ পথেও একে অপরের ওপর ড্রোন ও বিমান হামলা চালায়।
এরপর থেকে ফ্রান্সের সামরিক কর্মকর্তারা ও গবেষকরা খোঁজ নিয়ে দেখেছেন যে, পাকিস্তান চীনের তৈরি সামরিক সরঞ্জাম– বিশেষ করে যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র কীভাবে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। মূলত গবেষকরা খতিয়ে দেখেছেন যে- ভারতের কাছে থাকা রাফাল যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে চীনের তৈরি এসব সরঞ্জামের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকরী হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে।
রাফাল যুদ্ধবিমান এবং অন্যান্য অস্ত্র বিক্রি করে ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা শিল্প বড় ধরনের আয় করে থাকে। এছাড়া এর মাধ্যমে প্যারিস এশিয়াসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। অন্যদিকে এশিয়াতে চীন পরাশক্তি হিসেবে ক্ষমতা প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে।
বিমান হারানো কথা নিশ্চিত করেছে ভারত
সংঘাতের পর পাকিস্তানের পক্ষ থকে বলা হয়, তাদের আকাশ প্রতিরক্ষার মাধ্যমে ভারতের পাঁচটি বিমান ভূপাতিত করা হয়েছে। যার মধ্যে তিন রাফাল বিমান রয়েছে। এ অবস্থায় ফ্রান্সের কর্মকর্তারা বলছেন, যারা ফরাসি ডাসল্ট অ্যাভিয়েশনের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান কিনেছে তারা এর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ভারতও আনুষ্ঠানিকভাবে বিমান হারানোর কথা স্বীকার করে। তবে কতটি বিমান হারিয়েছে সে সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু বলেনি। ফরাসি বিমানবাহিনীর প্রধান জেনারেল জেরোম বেলাঞ্জার বলেছেন, তিনি এমন কিছু প্রমাণ দেখেছেন যা মাত্র তিনটি বিমান ধ্বংসের ইঙ্গিত দেয়। এর মধ্যে একটি রাফাল, একটি রাশিয়া নির্মিত সুখোই এবং একটি মিরাজ ২০০০, যা ফ্রান্সের তৈরি আগের প্রজন্মের যুদ্ধবিমান।
জেনারেল জেরোম বেলাঞ্জার বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতে ফ্রান্সের তৈরি রাফাল যুদ্ধবিমান ধ্বংসের ঘটনা এবারই প্রথম। দেশটি প্রায় আটটি দেশের কাছে এই বিমান বিক্রি করেছে। এখন এসব দেশ রাফালের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এ অবস্থার মধ্যে ফরাসি কর্মকর্তারা রাফালের সুনাম রক্ষার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন। তারা বলছেন, পাকিস্তান এবং তাদের মিত্র চীনের পক্ষ থেকে অনলাইনে পরিকল্পিত ‘রাফালে-বিরোধী প্রচারণা’ এবং মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর একটি সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে, যার বিরুদ্ধে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে।
ফরাসি কর্মকর্তারা আরও বলছেন, এই প্রচারণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল পোস্ট, বিকৃত করা ছবি যেখানে রাফালের ধ্বংসাবশেষ দেখানোর চেষ্টা করা হয়। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)-নির্মিত কনটেন্ট এবং ভিডিও গেমের দৃশ্য ব্যবহার করে কথিত যুদ্ধের পরিস্থিতি উপস্থাপন করা হয়েছে।
ফরাসি অনলাইন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য গবেষকদের মতে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুনভাবে খোলা ১ হাজারের বেশি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে চীনা প্রযুক্তির শ্রেষ্ঠত্বের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
ফ্রান্সের সামরিক কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এখনও অনলাইনে পরিচালিত ‘রাফাল-বিরোধী প্রচারণা’কে সরাসরি চীনা সরকারের সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম হননি।
তবে ফরাসি গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, বিভিন্ন দেশে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকগুলোতে চীনা দূতাবাসের প্রতিরক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একই বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তারা দাবি করছেন, ভারতীয় রাফাল যুদ্ধবিমানগুলোর পারফরম্যান্স ছিল দুর্বল এবং তারা চীনের তৈরি অস্ত্রের প্রচারণা চালাচ্ছেন।
গোয়েন্দা সংস্থা আরও জানিয়েছে, চীনা দূতাবাসের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা তাদের প্রচারণার মূল লক্ষ্য সেসব দেশকে নিয়ে করছে, যারা ইতোমধ্যে রাফাল বিমান অর্ডার দিয়েছে অথবা যারা ভবিষ্যতে রাফাল কেনার কথা বিবেচনা করছে। ফরাসি কর্মকর্তারা এসব বৈঠকের কথা জানতে পেরেছেন সেই দেশগুলোর কাছ থেকে, যাদের চীন এই প্রচারণার আওতায় এনেছিল।
ফ্রান্সের সশস্ত্র বাহিনী মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাফালকে লক্ষ্য করে ‘একটি বৃহৎ বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা’ চালানো হচ্ছে, যার উদ্দেশ্য ‘বিকল্প সরঞ্জামের শ্রেষ্ঠত্ব, বিশেষ করে চীনা ডিজাইনের অস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করা।’
ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, রাফাল বিমানকে অযথা লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়নি। কারণ এটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন যুদ্ধবিমান এবং এটি অনেক দেশে রপ্তানি করা হয়েছে।
এদিকে এপি চীনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে চীনের জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, চীনের বিরুদ্ধে এ ধরনের মন্তব্য ভিত্তিহীন, ভুয়া ও আত্মসমর্পণের সামিল। চীন সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির ক্ষেত্রে সবসময়ই সতর্ক এবং দায়িত্বশীল অবস্থান বজায় রেখেছে এবং আঞ্চলিক-বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতায় গঠনমূলক ভূমিকা রেখে চলেছে।’
ফ্রান্সের ডাসল্ট অভিয়েশন ৫৫৩টি রাফাল যুদ্ধবিমান বিক্রি করেছে। যার মধ্যে মিশর, ভারত, কাতার, গ্রীস, ক্রোয়েশিয়া, আরব আমিরাত, সাইবেরিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে রপ্তানি করা হয়েছে ৩২৩টি বিমান। ইন্দোনেশিয়ার আরও ৪২টি যুদ্ধবিমান ক্রয়ের বিবেচনা করছে।